আহমদ মতিউর রহমান: নেপালে জেন-জি অভ্যুত্থানের পর দেশটি এখন নির্বাচনের পথে। তরুণ বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের পর মাসখানেক আগে দেশটির সরকারের পতন ঘটে। দায়িত্ব নিয়েছে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুশিলা কার্কির মন্ত্রিসভায় সাত মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। এটি মন্ত্রিসভার স্বাভাবিক আকার নয়, বেশ ছোট। আগামী ৫ মার্চ নির্বাচন আহ্বান করা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর তোড়জোড় লক্ষণীয় নয়। জেন জি আন্দোলনের সময় পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি হঠাৎ জনসমক্ষে ফিরে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। তবে এর পরপর তার দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
অলির সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশিলা কার্কি। পরিস্থিতি বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের মতো। তবে সেখানে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নতুন সরকার। এবারের নির্বাচন কেমন হবে সে নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলমান। নেপালের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলা দরকার। যে পিআর নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক চলমান নেপালে তা রয়েছে, তবে আংশিকভাবে। বলতে গেলে অনন্য এক নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে নেপালে। একজন বিশ্লেষক লিখেছেন, নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। দেশটিতে জাতীয় ফেডারেল পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৭৫। এর ভেতর ১৬৫ জন (৬০ শতাংশ) সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। বাকি ১১০ জন (৪০ শতাংশ) দেয়া হয় দলগুলোর সর্বমোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হিস্যা অনুযায়ী। দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে, তবে তা আংশিক, ৪০ শতাংশ আসনে। সরাসরি ভোট বা ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) ও পিআর ভোট উভয়ের সমন্বয়ে নির্বাচনে গঠিত হয় পার্লামেন্ট।
হিমালয়ান টাইমস জানাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুসারে, নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে ইচ্ছুক দলগুলোকে নিবন্ধন করতে হবে। ১৭ নভেম্বর থেকে ১০ দিন সময় থাকবে। তফসিল অনুসারে, এফপিটিপি নির্বাচন কর্মকর্তাদের অফিস ১৬ জানুয়ারি, ২০২৬ থেকে শুরু হবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-পিআর সিস্টেমে এ ধরনের একটি অফিস ১ ডিসেম্বর খোলা হবে। প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী দলগুলোকে আগামী ২ এবং ৩ জানুয়ারি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় প্রার্থীদের নামের তালিকা জমা দিতে হবে।
নেপালের রাজনীতি দীর্ঘ দিন ধরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ইতিহাস, মাওবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে শান্তিচুক্তি, রাজতন্ত্রের অবসান এবং ২০১৫ সালের নতুন সংবিধান, এসব মিলিয়ে দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপট আজ এক জটিল গতি অর্জন করেছে। সা¤প্রতিক সময়ে যে প্রবল রাজনৈতিক ঘূর্ণি হাওয়া বইছে, তা কেবল নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ভেতর সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। এ ঘূর্ণি হাওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হলো অনিশ্চয়তা, জোটভিত্তিক সরকার, তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এবং প্রচলিত দলগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা। এর প্রভাব নেপালের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে, এটি নিশ্চত করে বলা যায়।
নেপালের রাজনীতিতে জোটের টানাপড়েন ছিল প্রধান একটি বিষয়। এ টানাপড়েন বেশ পুরনো। একক কোনো দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিগত নির্বাচনে। ফলে সরকার গঠিত হয় বহুদলীয় জোটের ভিত্তিতে। এতে সরকারের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নেপালে বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল আগামী বছর; কিন্তু নতুন সরকার ইতোমধ্যে তা ভেঙে দিয়ে আগামী বছরের ৫ মার্চ নির্বাচন আহ্বান করেছে। বিগত বছরগুলোতে কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে।
গত বছর জুলাইয়ে অলির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় ভিন্ন এক মেরুকরণে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী অলির দল ইউএমএল (ইউনাইটেড মাকর্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টি) জোট করেছিল চির প্রতিদ্বন্দ¦ী নেপালি কংগ্রেসের সাথে। অলি চীনঘনিষ্ঠ আর কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লির সাথে। তিনটি প্রধান দলের কেউ এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারায় তেলে জলে মিশ খাইয়ে গঠিত হয়েছিল সরকার। পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেসের সদস্য ছিল ৮৮ জন, অলির দলের ৭৬ জন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল প্রচন্দের মাওবাদী সেন্টারের ৩২ জন। তরুণদের আন্দোলনে অনেকে আক্রান্ত হন, অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নেন। পার্লামেন্টসহ সরকারি স্থাপনা মন্ত্রীদের বাসস্থান আক্রান্ত হয়। সেনাবাহিনী পরিস্থিতি শান্ত করে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী হচ্ছে? রাজনীতিবিদরা খোলস ছেড়ে বের হয়ে আবার ডুব দিয়েছেন। কে পি শর্মা অলি ঘোষণা দিয়েছেন, নেপালকে বর্তমান সরকারের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি পালাবেন না। নেপালের ভক্তপুরে এক সমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে অলি বলেন, ‘আমরা এ দেশ গড়ে তুলব। আমরা দেশকে আবার সাংবিধানিক ধারায় ফিরিয়ে আনব, শান্তি ও সুশাসন ফিরিয়ে আনব।’ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছাড়ার ১৮ দিন পর এটি ছিল অলির প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা। ৯ দিন নেপালের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সুরক্ষায় থাকার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি গুন্ডুুতে ভাড়া বাসায় গিয়ে ওঠেন। এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীরা ভক্তপুরের বালকোটে তার ব্যক্তিগত বাসভবন পুড়িয়ে দেন। সুশীলা কার্কির নেতৃত্বাধীন সরকারকে জনসমর্থনহীন সরকার বলে আখ্যা দিয়েছেন কে পি শর্মা অলি। অলি বলেন, ‘এ সরকার জনগণের ভোটে নয়; বরং লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে।’ কিন্তু এর পর তাকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি।
অন্য দিকে বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি। একই অনুষ্ঠানে সিপিএনর (ইউএমএল) ভাইস চেয়ারম্যান যুবরাজ জ্ঞানালি প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানকে সমর্থন করে বলেন, সঙ্কটময় সময়ে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। তিনি আসন্ন নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে সব রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান। সদ্য বিদায়ী সরকারের অংশীদার নেপালি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সদস্য উমেশ জং রায়মাঝি ঘোষণা করেন, তার দল অচিরে প্রচার শুরু করবে। প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নীলকান্ত উপ্রেতি বলেছেন, সম্পূর্ণ আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণ রাজনৈতিক বিবাদ দূর করতে এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর অধ্যাপক ড. খড়গ কেসি মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি সবচেয়ে ভালো সময়। জাতীয় তদন্ত বিভাগের প্রাক্তন প্রধান দেবীরাম শর্মা নির্বাচনের আগে পুলিশের মনোবল বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। সাংবাদিক কনক মণি দীক্ষিত জোর দিয়ে বলেছেন, জেনারেশন-জেড বিক্ষোভের সুষ্ঠু তদন্ত পরিচালনা করা দায়মুক্তি রোধ করতে অপরিহার্য। দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকের কথাতে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত যেমন আছে, তেমনি নির্বাচনী ধারায় ফেরার কথাও আছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দের দল মাওবাদী সেন্টারের কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে। দলের মুখপাত্র অগ্নি প্রসাদ সাপকোটা বলেন, এ ঘটনা জেনারেশন-জেড বিক্ষোভের পটভূমিতে ঘটেছে, যা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপ বাড়িয়েছে। নেতৃত্বের পরিবর্তনের আদর্শ, পদ্ধতি এবং পদ্ধতি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় চেয়ারম্যান প্রচন্দ দলীয় নেতাদের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক দৃশ্যপট সম্পর্কে অবহিত করেন। সেই সাথে একটি নতুন দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন।
নতুন নেতৃত্ব কী ভাবছে? নেপালে নির্বাচনে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন গণ-আন্দোলনের নেতা গুরুং, গড়ছেন দল। সরকারের বিরুদ্ধে জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের আন্দোলনের নেতা ঘোষণা দিয়েছেন, দেশে আগামী মার্চে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন। জনগণের সরকার গঠনে তারা ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন’। এক সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের নেতা সুদান গুরুং বলেন, প্রচলিত রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে ‘পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন’ গড়ে তুলতে দেশজুড়ে তারা সমর্থকদের সংগঠিত করার কাজ করছেন।
‘স্বার্থপর’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ সাবেক সরকার ও রাজনীতিকদের বিষয়ে গুরুং বলেন, ‘তারা আমাদের রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। যদি তারা রাজনীতি চান, তবে তাই পাবেন। আমরা পরবর্তী নির্বাচনে লড়ব। কারণ, আমরা এখন পিছু হটব না।’ ৩৬ বছর বয়সী গুরুং মূলত নেপালের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণ-অভ্যুত্থানের পরিচিত মুখ। এসব কথা তিনি বললেও আসন্ন নির্বাচনে তা কতখানি ফলদায়ক হবে বিশ্লেষকরা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
নেপালি কংগ্রেস, ইউএমএল এবং মাওবাদী সেন্টার নেপালের মূলধারার তিন রাজনৈতিক শক্তি। এরা রাষ্ট্র পরিচালনায় দীর্ঘ দিন প্রভাব রেখেছে; কিন্তু বিগত নির্বাচনে দেখা গেছে, নেপালি কংগ্রেস সর্বাধিক আসন পেলেও এককভাবে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে দ্বিধা তাদের দুর্বল করেছে। ইউএমএল এখনো শক্তিশালী সংগঠন বজায় রাখলেও নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। মাওবাদী সেন্টার একসময়ের প্রভাবশালী দল আজ জোট রাজনীতির আশ্রয়ে বেঁচে আছে।
নেপালের রাজনীতিতে ঘূর্ণি হাওয়ার বড় কারণ হলো নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব। এ নতুন শক্তি প্রচলিত দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপালের রাজনীতিতে যে ঘূর্ণি হাওয়া বইছে, সেটি গণতন্ত্রের পরিপক্বতার অংশ বলা যায়। তবে এ হাওয়া স্থায়ী ঝড় হয়ে দাঁড়ালে তা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। রাজনীতির পুরনো খেলোয়াড়দের উচিত নিজেদের দায় স্বীকার করে তরুণ নেতৃত্বের জন্য জায়গা তৈরি করা। আর নতুন শক্তির উচিত কেবল আবেগ নয়, বাস্তবসম্মত নীতি ও কার্যকর শাসনের রূপরেখা দেয়া। অতএব, নেপালের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ ঘূর্ণিঝড়কে তারা কেবল ধ্বংসের শক্তি হিসেবে দেখবে, নাকি পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে।
লেখক : সাংবাদিক
সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669 / 01712596354
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত Bd24news.com