মামুনুর রশীদ নোমানী :
বরিশালে সড়কপথে গাড়ির সামনে পিছনে লাগানো থাকে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের স্টিকার। দেখলে মনে হয় প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন। স্টিকার লাগানো এই গাড়িগুলো দেখলে সড়কে দায়িত্বরত সার্জেন্ট এবং পরিবহন শ্রমিকরাও সমীহ করে ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসলে প্রচার নয়, প্রশাসনিক হয়রানি এবং পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে কল্যাণের চাঁদা যেনো না দিতে হয়, তার সতর্কস্বরূপ প্রতিকী হিসেবে এই স্টিকার সাঁটানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে মাহেন্দ্র ও সিএনজি মালিকপক্ষ কথিত ঐসব সাংবাদিকদের ব্যবহার করে সড়কপথে নিজেদের গাড়িগুলো নিয়ে নির্ঝঞ্জাট রাখতেই এই কৌশল নিয়েছে। বিপরীতে কথিত এসব সংবাদকর্মীদের দেওয়া হয় মাসিক “বিটমানি”। অর্থাৎ গাড়িপ্রতি একহাজার টাকা হারে উত্তোলন করে। এভাবে একেকজন কথিত সংবাদকর্মীদের ভাগে রয়েছে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি গাড়ি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক নেতা জানালেন, এনিয়ে সাম্প্রতিকালে এসব কথিত সংবাদকর্মীদের সাথে মাহেন্দ্র শ্রমিক ইউনিয়নের সস্পর্কের টানাপোড়ন দেখা দিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিবহন শ্রমিক সংগঠন কোনেভাবেই পেরে উঠছে না অতিব প্রভাব দেখানো এই প্রতারক সংবাদকর্মীদের সাথে। এমনকি ট্রাফিক বিভাগও যেনো অসহায়।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, বরিশাল নগরী এবং নগরীর থেকে বাইরে যাওয়া এবং আসা অন্তত ’কয়েকশ মাহেন্দ্র ও সিএনজি নিয়ন্ত্রণ করে বরিশাল জেলা সিএনজি ও অটোরিকশা মালিক সমিতি ইউনিয়ন। রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত ইউনিয়নটি তাদের নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো দেখভাল করার পাশাপাশি প্রতিগাড়ি থেকে মাসে বিশেষ অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে শ্রমিকদের কল্যাণে তহবিল তৈরী করে।যা
বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনায় আহত অথবা নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ওই তহবিল থেকে অর্থসহায়তা দেয়া হয়। পাশপাশি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা শ্রমিকদের বেতন অনুসারে মাসিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়। ট্রাফিক পুলিশদের সহায়তায় এই শ্রমিকদেরও ভূমিকা রয়েছে। অখ্যাত এসব মিডিয়ার একটি অংশ মাহেন্দ্র ও সিএনজি এবং অটোচালিত মোটরযান থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে অর্থ উত্তোলনের বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছে না।
অভিযোগ রয়েছে, এই টাকা উত্তোলনের কারণে শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে আর্থিক সুবিধা চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে বায়না ধরেছিলো। কিন্তু সাড়া না মেলায় প্রথমে তারা কোন গাড়ি ধরলেই সুপারিশ করতো এবং গাড়ি মালিকপক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন। এখন প্রতিদিন সুপারিশ নয়, বরং তাদের নাম সর্বস্ব পত্রিকা এবং প্রতিনিধিত্বকারী বিশেষ এই কথিত সংবাদকর্মীরা তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কাছে গাড়ি নাম্বারসহ একটি তালিকা ধরিয়ে দেয়. যাতে তাদের তালিকায় থাকা নম্বরধারী মাহিন্দ্র ও সিএনজি থেকে মাসিক চাঁদা উত্তোলন অথবা রিকুইজিশনের অন্তর্ভূক্ত করা না হয়।
ওই শ্রমিক নেতা জানান এবং বেশ কয়েকজন চালক স্বীকারও করেন, এরপর থেকেই কথিত সংবাদকর্মীরা তাদের সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার স্টিকার এই পরিবহনগুলোর সামনে এবং পিছনে সেটেঁ দেয়। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক সার্জেন্টরা কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ থাকায় ওই তালিকায় থাকা গাড়ি ধরলেই মিডিয়ার পরিচয়ে কখনো মুঠোফোনে শাসিয়ে কথা বলে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার একধরনের হুমকি ছুঁড়ে দেয়। কোনো কোনো নাছোড়বান্দা সার্জেন্ট এই হুমকি উপেক্ষা করে ত্রুটিপূর্ণ কাগজ এবং রংসাইডে চালানোর অভিযোগে মামলা জুড়ে দেয়াসহ ধরে নিয়ে আসলে স্বয়ং সেই কথিত সংবাদকর্মীরা উপাস্থিত হয়ে যান। নিজের গাড়ি বলে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি)র কাছে নিজের পরিচয় এমনভাবে জাহির করে, যেনো তিনি বড়ো মাপের সাংবাদিক! সুতরাং সহানূভূতির চোখে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া এবং মামলার ক্ষেত্রে জরিমানার অঙ্ক হ্রাস করা হয়।
মাসের শেষে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মাসিক চাঁদার জন্য এধরনের গাড়ি আটকালেই আলোচনায় আসা এই সংবাদকর্মীরা নিজের পরিচয় দিয়ে কেনো গাড়ি ধরা হলো, তার কৈফিয়ত চান। পুলিশ ও শ্রমিকের একটি সূত্র জানায়, জেলা ও মেট্রো পুলিশের নৈশকালীন ডিউটিতে তাদের গাড়ি স্বল্পতায় রিকুজিশনের মাধ্যমে সিএনজি এবং অটোচালিত জান মাহিন্দ্র মাসিক চক্রবৃদ্ধি হারে প্রতিদিন অন্তত ৪০ টি প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এই গাড়ি সংগ্রহের জন্য জেলা সিএনজি ও অটোরিকশা শ্রমিক সমিতি ইউনিয়নের দায়িত্বে কোন গাড়ি কোনদিন ডিউটিতে যাবে, তার তালিকা অনুসারে জেলা পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের দেয়া তালিকায় থাকা গাড়ি ধরামাত্রই শুরু হয় ছাড়িয়ে নেওয়ার জোর-জবরদস্তিমূলক প্রভাব। একেতো বড় সাংবাদিক, তার ওপর কেউ নিজেকে ক্ষমতাসীন দলীয় শীর্ষ নেতার আত্মীয় আবার কেউ জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একান্ত লোক হিসেবে প্রভাব দেখানোর ফলে মাসিক চাঁদা তো দূরের কথা, রিকুজিশনেও তাদের গাড়ি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়না।
একেকজন সাংবাদিকের নামে চলে ২০ থেকে ১৫টি গাড়ি। আবার এমন সাংবাদিকও রয়েছেন, লিখতে গেলে কলম ভাঙ্গে অথবা ছবি তুলতে গেলে নিজের পরিচয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষার দৌড় কতখানি তা আপনা আপনি প্রকাশ পায়, এধরনের মিডিয়াকর্মীদের নামেও ৫/৭ টি গাড়ি রয়েছে।অথচ তারা একটি গাড়িরও মালিক নয়। শ্রমিক ও ট্রাফিক পুলিশও নিশ্চিত হয় প্রকৃতভাবে গাড়িগুলোর মালিক তারা নন তারা।মূলত শ্রমিকদের চাঁদা ও প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষায় এধরনের সাংবাদিকরা বিভিন্ন মালিকের সাথে গাড়িপ্রতি একহাজার টাকা চুক্তিতে পুলিশ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ভাষায় বিটমানি নিচ্ছেন। অর্থাৎ ব্যতিক্রমী চাঁদাবাজি। এই পন্থায় কোনো কোনো সাংবাদিক মাসে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা নিচ্ছেন অনেকেরই অলক্ষে। কাকতালীয়ভাবে খুঁজে পাওয়া গেলো এই তালিকায় থাকা একটি বেশ জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলের স্বনামধন্য এক সাংবাদিকের নাম। যার অনুকূলেও রয়েছে বেশ কিছু মাহেন্দ্র ও সিএনজি।
শ্রমিক নেতাদের দাবি, পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, শ্রমিক ইউনিয়ন যেনো এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে কথিত মিডিয়ার একটি অংশ।
বাস্তবতাও সেকথা বলে। সড়কে দেখা যায় , যেসমস্ত গাড়িতে পত্রিকার স্টিকার রয়েছে, সেই গাড়িতে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের স্টিকার নেই। অর্থাৎ মাসিক চাঁদা পরিশোধকারী মাহেন্দ্র ও সিএনজির সম্মুখভাগে তাদের নিজস্ব প্রতীক সম্বলিত স্টিকার দেখা যায়। বলা যায় এখন দুই কূল থেকে মাহেন্দ্র, সিএনজি ও অটোচালিত মোটরযান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই নিয়ে প্রায় সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির অবতারণা ঘটে। মালিকপক্ষ থাকে দূরত্বে অথবা অন্তরালে। পরস্পর পরস্পরকে চাঁদাবাজ বলে আখ্যা দিচ্ছে।
বরিশাল জেলা থ্রি হুইলার মালিক শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান দুলাল জানান, তাদের সংগঠন রেজিস্ট্রেশনভুক্ত এবং দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি শ্রমিকদের কল্যাণে তহবিল গঠনের জন্য মাসের একটি নির্ধারিত অঙ্কের টাকা মালিকপক্ষের কাছ থেকে নেয়া হয়। যা শ্রমিকদের বিপদ আপদে খরচ করা হয়। এখন এর একটি বৃহৎ অংশ গুটিকয়েক সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাফিক বিভাগও এদের কাছে অসহায়।
এপ্রসঙ্গে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক একজন কর্মকর্তা জানান, আইন সবার জন্য সমান। কোনো গাড়িতে পত্রিকার স্টিকার থাকলেও কোনো ছাড় নেই বলে তার অধীনস্থ সার্জেন্টদের একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অনেকে তাদের মিডিয়ার স্টিকার পরিবহন থেকে অপসারন শুরু করেছে বটে কিন্তু কোনো গাড়ি আটক করলে এমনভাবে সুপারিশ রাখছে, ছেড়ে না দিয়ে উপায় নেই।
সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669 / 01712596354
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত Bd24news.com