বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: আগে ছিলেন ভূমিহীন ও ঋণগ্রস্ত। ২০০৮ সালে প্রথম যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তখন হলফনামায় এমনই উল্লেখ ছিল। গত ১৫ বছরের ব্যবধানে তিনি এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন আলিশান বাড়ি, ঢাকার শহরে ফাট, নামে-বেনামে রয়েছে বিঘা বিঘা জমি। কিভাবে এত অল্প সময়ে অঢেল ধনসম্পদ বিত্ত-বৈভব বানিয়ে কোটিপতি বনে গেলেন তা যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। বলছি আওয়ামী লীগের বাকপটু নেতা শাহরিয়ার আলমের কথা। তিনি ছিলেন রাজশাহী-৬ আসনের এমপি ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তার বিত্ত-বৈভবের উত্থান দেখে মনে হবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি পেয়েছিলেন আলাদীনের চেরাগ।
এলাকাবাসী জানান, শাহরিয়ার আলম ছিলেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। সেখান থেকে হয়েছেন রাজনীতিবিদ। এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার পর পরই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে তার সম্পদ। তিনি স্থানীয় রাজনীতির মাঠেও ছিলেন ‘মাফিয়া’। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারীদের হয় নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে নতুবা যেতে হয়েছে জেলে। এভাবে মতার দাপট দেখিয়ে নির্বাচনী এলাকা চারঘাট-বাঘা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন আবাদী জমি, বিভিন্ন ধরনের বাগান, ফ্যাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি ও মতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন শাহরিয়ার আলম। দলিল লেখক সমিতির কমিটি গঠন করে দিয়ে সেখান থেকে প্রতি মাসে বড় অংশের কমিশনও পেতেন। এভাবে শুধু দেশে নয়; বিদেশেও পাচার করেছেন অঢেল সম্পদ। রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে অর্থ পাচার করে তিনি খুলেছেন বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তার রয়েছে ২৫টি পোশাক কারখানা। নিয়েছেন টেলিভিশনের লাইসেন্স, গড়ে তুলেছেন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
প্রথম হলফনামায় ছিলেন ভূমিহীন ও ঋণগ্রস্ত : ১৯৯৫ সালে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন শাহরিয়ার আলম। এরপর রাজশাহী-৬ আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবার আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর। প্রথমবার নির্বাচনী হলফনামায় দেখিয়েছিলেন তিনি ভূমিহীন। ছিল দুই কোটি তিন লাখ ২০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ, যার বিপরীতে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকা। আর নিজের পোশাক কারখানার নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এ সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালে তার নামমাত্র গার্মেন্টস থাকলেও বর্তমানে তার মালিকানাধীন গার্মেন্টসের সংখ্যা অন্তত ২৫টি। ২০০৮ সালের তুলনায় বর্তমানে সম্পদ বেড়েছে ৫৫ গুণ। অভিযোগ রয়েছে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাবস্থায় মতার অপব্যবহার করে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন এবং নিজের কোম্পানিতে চাকরিরত ভারতীয়দের হুন্ডির মাধ্যমে তিনি বেতন দিতেন।
ভূমিহীন থেকে যেভাবে কোটিপতি : শাহরিয়ার আলমের বাবা মো: শামসুদ্দিন ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলের কর্মচারী। সেই সুবাদে তাকে থাকতে হয়েছে লালমনিরহাটে। সেখানেই কেটেছে তার ছোটবেলা। সেই সুবাদেই লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি ক্রয় করে গড়ে তুলেছেন খামারবাড়ি। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজুল ইসলাম সিরাজের বাড়িও ওই কালীগঞ্জে। স্থানীয় সূত্র বলছে, ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় চারঘাট-বাঘায় হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন শাহরিয়ার আলম। কিছু খাদ্যসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে চারঘাট-বাঘার মানুষের কাছে পরিচিতি পান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হিসেবে। এরপর হঠাৎ আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন শাহরিয়ার আলম। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচনে এমপি হলে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
দুদক ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে হলফনামায় ভূমিহীন দেখালেও গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি অবৈধ উপায়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকার গুলশানে নিজের নামে দু’টি, পুত্রের নামে একটি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে নিয়েছেন তিন হাজার ৬০০ বর্গফুটের রাজকীয় ফ্যাট। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে গড়েছেন আলিশান বাড়ি, জমি, ফ্যাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অঢেল সম্পদ। তার উত্থান দেখে স্থানীয় মানুষ হতবাক! তাদের ধারণা, আলাদীনের চেরাগ পেলেই কেবল এত অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে তার নির্বাচনী এলাকা চারঘাটে পোশাক কারখানা স্থাপনসহ নানা প্রলোভন ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে স্বল্পমূল্যে কোটি কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন। চারঘাট-বাঘা মহাসড়কের পাশে মেরামতপুর এলাকায় অবস্থিত লিলি সিনেমা হল ২০১০ সালের বন্ধ হয়ে গেলে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে সিনেমা হলের ভবনসহ কয়েক কোটি টাকার ৩৭ শতক জমি মাত্র ৫০ লাখ টাকায় দফারফা করেন। ওই ভবনে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপনের কথা থাকলেও গত ১০ বছরে একটি পিলারও ওঠেনি। ২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্ব পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করেন তিনি। দুদক সূত্র বলছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে ৫২ বিঘা নিয়ে নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড নামের একটি কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন শাহরিয়ার আলম। এর মধ্যে ১২ বিঘা রয়েছে খাস জমি। ২০২০ সালে সেখানে একই প্লটে ৪১ বিঘা জমি ক্রয় করেন তিনি। জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলার বাঘা পেট্রোল পাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ, জমির মূল্য পরিশোধ না করেই শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন। একই সাথে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে দখল করেন ১২ বিঘা খাস জমি। এ ছাড়া ঠাকুরগঁাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি ক্রয় করেন শাহরিয়ার আলম। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর এসব জমি ও অর্থসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারো টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
শাশুড়িকে যেভাবে মেয়র বানালেন : বাঘা উপজেলার পার্র্শ্ববর্তী নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার আলম। এরপর প্রথম স্ত্রী আয়েশা আক্তার ডালিয়াকে তালাক দেন তিনি। পরে প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পন্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার আলম। আর দ্বিতীয় স্ত্রী লেনিকে লালপুরে কয়েক কোটি মূল্যের রাজপ্রাসাদ করে দেন শাহরিয়ার। ঢাকার গুলশানেও দ্বিতীয় স্ত্রী লেনিকে তিন হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্যাট উপহার দেন।
শাহরিয়ার আলমের গাড়ি বিলাস : শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময় ১০ লাখ পাঁচ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে এবং স্ত্রী ২৭ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রায়াল গাড়িতে চড়তেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত তাকে এক কোটি এক লাখ তিন হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে এবং তার স্ত্রীকে এক কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের গাড়িতে চড়তে দেখা যায়।
বরাদ্দ তছরুপের অভিযোগ : স্থানীয় ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে চারঘাটে ১১৮ টন গম বা চালের আওতায় ১৮ প্রকল্প ও বাঘা উপজেলা ২২ প্রকল্পের বিপরীতে ১৬৮ টন চাল বা গম বরাদ্দ দেয়া হয়। একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হয় আরো ২৫০ টন চাল বা গম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাঘা-চারঘাট এলাকায় ২৩০ প্রকল্পের আওতায় দুই পর্যায়ে ৬০০ টন চাল বা গম বরাদ্দ দেয়া হয়। এভাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দুই পর্যায়ে ৫২টি প্রকল্পের আওতায় চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় ১০০ টন চাল বা গম বরাদ্দ হয়। এ ছাড়া প্রতিবছরই প্রায় এক কোটি টাকা হারে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে। কিন্তু বেশিরভাগ বরাদ্দই তছরুপ হয়েছে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক নিয়োগেও তিনি বাণিজ্য করতেন। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারো টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
দুদকের মামলা : সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মতার অপব্যবহার করে ২৭ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তার নিজ নামের ছয়টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ২৬০ কোটি ৯৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩০ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতাও মিলেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে জানা গেছে। গত ২৪ এপ্রিল শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। তার স্ত্রীর নামেও নোটিশ পাঠিয়েছে সংস্থাটি। যদিও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, শাহরিয়ার আলম গত ৫ আগস্ট ভোরেই ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরে তারা শুনেছেন, সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। আত্মগোপনে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669 / 01712596354
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত Bd24news.com