বিডি ২৪ অনলাইন নিউজ: রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক পথ ধরে হাঁটলে চোখে পড়ে এক জরাজীর্ণ ভবনের ব্যানার—রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি। এটি ঢাকার প্রথম পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত এই লাইব্রেরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেটের সামনে দিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পাশ ধরে এগোলে ডান পাশে নজরে আসে এই প্রাচীন স্থাপনা।
প্রথমে লাইব্রেরিটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে ভবনের দেয়ালে জন্ম নেয় একটি বিরাট বট গাছ। যা ভবনকে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে পাঠাগারটি বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তরিত হয়েছে। কালের বিবর্তনে এই পাঠাগারের অস্তিত্বের ওপর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখন পাঠাগারটি প্রায় পরিত্যক্ত। একসময় হাজার হাজার বই থাকলেও আজকের দিনে সেখানে বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এই পাঠাগারের ইতিহাস একসময়ের জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রতীক। জানা গেছে, একসময় এখানে ৩০,০০০-এরও বেশি বইয়ের সংগ্রহ ছিল। প্রায় সব ধরনের বইয়ের দেখা মিলত এখানে। বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কিত বই। শুরুর দিনগুলোতে শত শত মানুষ ব্রাহ্ম সমাজের অঙ্গনে বই পড়তে এবং আলোচনা করতে আসতেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাঠাগারে ধ্বংসাত্মক হামলা চালায় এবং বহু মূল্যবান বই লুট হয়ে যায়।
বেদের একেশ্বরবাদের ওপর নির্ভর করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ। ব্রাহ্ম সমাজে রামমোহনের সঙ্গে আরও ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুরান ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মকর্ম সংস্কারের পাশাপাশি ১৮৭১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অভয় চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের নামানুসারে এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয়।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, এই পাঠাগারে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসেছেন। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসে যে তিনটি দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার একটি ছিল এই পাঠাগার। এছাড়া এখানে সময় কাটিয়েছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল এবং কবি শামসুর রাহমান।
আজকের দিনে পাঠাগারটি পূর্বের গৌরব হারিয়েও রয়েছে। ছোট্টস্থান হলেও এটি ঢাকার শিক্ষাজীবী ও গবেষণার ইতিহাসের অমর সাক্ষী। বইয়ের সংখ্যা কমে গেলেও, এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ এখনও সমান, কারণ পাঠাগারটি দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ পায়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। মন্দিরের দোতালায় সেই পুরনো চিকন সিঁড়ি দিয়ে উঠার পর এই ছোট্ট একটা লাইব্রেরী। আনুমানিক ২০০ স্কয়ার ফিটের এই রুমে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দেওয়ালে টাঙানো বিভিন্ন কবি-লেখক ও বিশ্ব এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ছবি। যেমন— সুকান্ত ভট্টাচার্য, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুফিয়া কামাল, শের-ই-বাংলা এ কে এম ফজলুল হক, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনান্দ দাস, পল্লী কবি জসিম উদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জসীমউদ্দীন ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য সাহিত্যিকদের আলোকচিত্র। লাইব্রেরিতে ব্রাহ্ম ধর্মীয় গ্রন্থের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্র রচনাবলি রয়েছে। বর্তমানে দর্শনার্থীর আগমন কম হওয়ায় লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা আগে থাকার অর্ধেকের কাছাকাছি হ্রাস পেয়েছে।
রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরির জরাজীর্ণ ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। ২০০৫ সালে তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে রিট করে ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০০৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে ভবনটি পুরাকীর্তি আইনের আওতায় পড়ে না বলে জানায়।
জানা গেছে, ঢাকার প্রথম যে পাঠাগারটি (লাইব্রেরি) পুনর্নির্মাণ ও পরিবর্ধনের পরিকল্পনা ছিল, সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ, রাজউক কর্তৃপক্ষের তৈরি ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় পাঠাগারটির নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা বা কাঠামোগত পরিবর্তন করা আইনগতভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি যুগান্তরকে বলেন, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতো গবেষণার জন্য। পাঠকের জন্য সব সময় উন্মুক্ত থাকলে আশানুরূপ পাঠক পাওয়া যায় না। তবে আদালতে মামলা চলমান থাকায় পাঠাগারটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এ মুহূর্তে মন্তব্য করতে চাই না।
রণবীর পাল রবি আরও জানান, এর আগে ব্রাহ্মণ সমাজ গেট সংলগ্ন দুই হাজার সালের আগে পুরাতন আরেকটি ভবনের দোতলায় এর লাইব্রেরী চালু ছিল। কিন্তু সেটি ২০০০ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসাবে চিহ্নিত করায় এটি স্থানান্তর করে বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। প্রায় ২০ স্কয়ার ফিটের এই জায়গাটিতে বর্তমানে লাইব্রেরি রয়েছে। এখানে সব সময় দর্শনার্থী আসেনা; শুক্রবার দিন কিছু লোক আসে। এখন এখানে পাঠাগারে পড়তে আসার লোকের চাইতে দর্শনার্থীর সংখ্যায় বেশি, তারপরেও ইদানিং অনেক খানি কমে গেছে দর্শনার্থী।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা শামীম হাওলাদার যুগান্তরকে জানান, রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার আমাদের পুরান ঢাকার গর্ব, আমাদের সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক পরিচয়। একসময় এখানে বই-পাঠ আর আলোচনার আলো জ্বলত, আজ তা ধুঁকতে থাকা এক ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। আমরা এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, এই পাঠাগারকে জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নতুন প্রাণ দেওয়া হোক। এটি শুধু একটি ভবন নয়—এটি আমাদের প্রজন্মের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যা সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি শুধুই একটি বইয়ের ঘর নয়; এটি ঢাকার শিক্ষাজীবী ও গবেষণার ইতিহাসের এক অমর সাক্ষী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার সাহিত্য, দর্শন, ধর্মীয় চর্চা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এই পাঠাগারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানে বেড়ে উঠেছে অজস্র শিক্ষার্থী, গবেষক ও সাহিত্যপ্রেমী, যারা সময়ের পরিবর্তনেও এই স্থাপনার মৌলিক শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
কিন্তু যেভাবে কালের ব্যবধানে ভবন ও বইয়ের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে, তাতে এই ঐতিহাসিক পাঠাগারের ভবিষ্যৎ আজও অনিশ্চিত এবং এর সংরক্ষণ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পাঠকের জন্য খোলার বিষয়টি এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669 / 01712596354
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত Bd24news.com