বিডি ২৪ নিউজ রিপোর্ট: গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা ইলিয়াস আহম্মেদ। সরকারি দায়িত্বে থেকেই ঘুষ, কমিশন, অনিয়ম ও অর্থ পাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি এমনই অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি সিলেট গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। অথচ তার বিরুদ্ধে দায়ের রয়েছে একটি ফৌজদারি মামলা (সি.আর নং১১৮/২০২৫), যেখানে তিনি ১১০ নম্বর আসামী।
মামলাটি দণ্ডবিধির ১৪৭/১৪৮/৩২৬/৩০৭/৫০৬/৩৪ ধারায় চলমান। অভিযোগ রয়েছে-একজন মামলার আসামী ও দুর্নীতির অভিযুক্ত কর্মকর্তা হয়েও তিনি এখনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল আছেন। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী অভিযুক্ত ও আদালতে চলমান মামলার কর্মকর্তা সাধারণত প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে বিরত থাকেন; কিন্তু ইলিয়াস আহম্মেদ তার ব্যতিক্রম। ইলিয়াস আহম্মেদ ২০১৫ সাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন গণপূর্ত বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রশাসনিক নথি অনুসারে, তার চাকরির সময়সূচি নিম্নরূপ: ২২ এপ্রিল ২০১৫: ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-২, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: নড়াইল গণপূর্ত বিভাগ, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭: ঢাকা বিভাগ-২
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭: আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগ, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩: তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, গণপূর্ত সার্কেল-১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩: তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, গণপূর্ত সার্কেল, সিলেট ঢাকায় প্রায় এক যুগ দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বিতর্কিত ঠিকাদার জি.কে. শামীমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে সূত্র জানায়। এক সময় জিকে শামীমের সঙ্গে সরকারি কাজের “কমিশন বাণিজ্য” এবং “চুক্তি বণ্টনের কারসাজি” নিয়ে গণপূর্তের অভ্যন্তরে আলোচনা তৈরি হয়।
জিকে শামীম-সংযোগে বিতর্ক : ২০১৯ সালে জিকে শামীমের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও চাঁদাবাজির মামলার পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা অভিযুক্ত হন। ইলিয়াস আহম্মেদ সরাসরি অভিযুক্ত না হলেও, তার নাম শামীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে একাধিক প্রতিবেদনে উঠে আসে। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইলিয়াস ঢাকায় জিকে শামীমের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ ও কাজ বণ্টনে প্রভাব খাটাতেন। সরকারি নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও বিল ছাড়ের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের কমিশন নেওয়া ছিল প্রকাশ্য গোপন খবর।
আজিমপুর গণপূর্তে শিশু জিহাদ মৃত্যুর ঘটনা : ইলিয়াস আহম্মেদের নাম আলোচনায় আসে আজিমপুর গণপূর্ত বিভাগের একটি মর্মান্তিক ঘটনায়। ২০১৯ সালের শেষের দিকে আজিমপুরের পিলখানা উপবিভাগের কাজের সময় শিশু জিহাদের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় অবহেলা ও নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ ওঠে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, ইলিয়াস আহম্মেদ নিহত শিশুর পরিবারকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এবং শিশুর ভাই গোলজারকে গণপূর্ত বিভাগে পিয়ন পদে চাকরি দিয়ে বিষয়টি “মীমাংসা” করে ফেলেন। সেই ঘটনায় প্রশাসনিক তদন্ত হলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি কোনোরূপ শাস্তি এড়িয়ে যান। আজিমপুর বিভাগের অধীনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ইলিয়াস আহম্মেদের বিরুদ্ধে ঠিকাদার পল্টন দাসের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ১২০ কোটি টাকা। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি “পছন্দের ঠিকাদার” বেছে নিয়ে কাজ দেন এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিনিময়ে প্রতি ফ্ল্যাটে ৫৭ লাখ টাকা করে কমিশন গ্রহণ করেন। একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইলিয়াস স্যার চুক্তি অনুমোদনের আগে ৫ শতাংশ কমিশন দাবি করতেন। কাজের বিল ছাড় করতে চাইলে আরও ২ শতাংশ দিতে হতো। এই ঘুষ বাণিজ্যে তার নিকট আত্মীয়রাও যুক্ত ছিল। অভিযোগ রয়েছে, তার আপন ভাইকে ঠিকাদার বানিয়ে তিনি গণপূর্তের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দেন এবং কমিশনের ভাগ নিতেন। অবৈধ সম্পদের পাহাড়- দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে ইলিয়াস আহম্মেদ দেশের ভেতর ও বাইরে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
তাদের ভাষায়-ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নিজ জেলা বরিশালে কোটি টাকায় নির্মিত একটি মসজিদ, বিদেশের মাটিতে দোতলা একটি বাড়ি, এবং ব্যাংক ও আত্মীয়দের নামে বিপুল অর্থের জমা- সবই তার অবৈধ উপার্জনের ফল। এছাড়া ঢাকার অভিজাত হোটেলে ঠিকাদারদের সঙ্গে বিলাসবহুল আসর ও পার্টিতে অংশ নেওয়া, মদ্যপান ও নারীসঙ্গের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “তিনি নিয়মিতভাবে হোটেল র্যাডিসন ও সোনারগাঁওয়ে ঠিকাদারদের নিয়ে ‘গেট টুগেদার’ আয়োজন করতেন। সেখানে বিলাসিতা ছিল চোখে পড়ার মতো।” বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা : ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার পেছনে অর্থ সহায়তার অভিযোগ ওঠে ইলিয়াস আহম্মেদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, তিনি সরকারপন্থী একটি গোষ্ঠীর হয়ে “ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ” করেন। এ ঘটনায় সি.আর মামলা নং ১১৮/২০২৫এ তিনি ১১০ নম্বর আসামী হন। তবে মামলার তদন্ত শেষ না হলেও তাকে সিলেট সার্কেলে পদায়ন করা হয়।
সিলেটে যোগদানের পরও ইলিয়াস আহম্মেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সূত্র জানায়, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েকটি সরকারি নির্মাণ কাজে ‘নিজস্ব ঠিকাদার’ নিয়োগ দেন। এমনকি নতুন প্রজেক্ট অনুমোদনের ক্ষেত্রেও “কমিশন ছাড়া কোনো কাজ না হওয়া”এমন অভিযোগ স্থানীয় ঠিকাদারদের মুখে শোনা যায়। তাদের ভাষায়, “স্যার এখন সিলেটেও সেই পুরনো পদ্ধতিই চালু রেখেছেন। আগে কমিশন, পরে অনুমোদন। জনমনে প্রশ্ন-একজন অভিযুক্ত কর্মকর্তা কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে বহাল থাকতে পারেন? প্রশাসনিকভাবে এমন কর্মকর্তা বরখাস্ত বা ওএসডি হওয়ার কথা থাকলেও ইলিয়াস আহম্মেদ বরং পদোন্নতি পেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাধারণত বিভাগীয় তদন্ত হয়। কিন্তু প্রভাবশালী কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে তা এড়িয়ে যান।”
ইলিয়াস আহম্মেদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, তিনি মালয়েশিয়া ও দুবাইতে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টাকা স্থানান্তর করেছেন। তার এক সহকর্মী জানান, “তিনি প্রায়ই বিদেশ সফরের নামে ভ্রমণ করতেন। সন্দেহ করা হয়, সেই সময় তিনি বিদেশে টাকা স্থানান্তর করেছেন।”যদিও এসব তথ্যের কোনো সরকারি স্বীকৃতি এখনো পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আহম্মেদের মতো বিতর্কিত কর্মকর্তা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একজন সিনিয়র প্রকৌশলী বলেন, “যখন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পান, তখন সৎ কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত হন। ইলিয়াসের মতো কর্মকর্তাদের জন্যই সাধারণ মানুষ গণপূর্তকে দুর্নীতির কেন্দ্র বলে মনে করে। অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে ইলিয়াস আহম্মেদের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: ইমেইল: nomanibsl@gmail.com মোবাইল: 01713799669 / 01712596354
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত Bd24news.com