এই বছরের ঈদ-উল-ফিতর আর কবি নজরুলের জন্ম দিন একই তারিখেই হচ্ছে ২৫ ই মে । ঈদ নিয়ে এই পৃথিবীতে যত গান আছে , সকল গানের মধ্যে নজরুলের গানই সবচেয়ে বেশী মনকাড়া। পাগল করা। কবি নজরুলের “'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ “ এই গান না শুনলে কেমন যেন ঈদের আমেজ ভর করে না। নজরুলের এই গান ঈদের জাতীয় সঙ্গীতের রুপ নিয়েছে। গান থেকে আমাদের ঈদের তৃপ্তির সূত্রপাত ঘটে। শেষ রোজার ইফতার এর পরপরই এই গান যখন বেজে উঠে তখন মনের ভেতর আনন্দের একটি দোল খেলে যায়। বিশ্বাস করুন এই গান টি এখন সর্বজনিন । আমরা ধরে নিতে পারি সকল ধর্মে মানুষ এ গানটি শুনেন। কবি সর্বজনিন তাই গানও । নজরুলের এই ঈদ আগমনি গানের মধ্যে মানব জাতির জন্য একটি বার্তা রয়েছে । বাইশ লাইনের এই গানের অন্তর্নিহিত ভাবে রয়েছে মানুষের নিজের মনের পশুত্ত্বকে বিসর্জন দিয়ে মন উজার করে আসমানের তাগিদ মেনে নেওয়া। কবি এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যেতে বলেছেন। করোনা মহামারি বলয়ে আবদ্ধ এবারের ঈদ আনন্দ । আমাদের দেখা এটাই প্রথম ঈদ যে ঈদে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা নিরাপদ এটি নিশ্চিত করতে পারাটাই হবে মূল আনন্দ। আর আমরা যে নিরাপদ এ কথা তখনই বলা যাবে যদি আমরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে পারি । কিন্তু আমাদের অবস্থান কি সে রকম ছিল? খবরে দেখেছি মানুষ গ্রামের বাড়ি ছুটছে। তবে ধনীরা। ধনীরা বরাবরই একটু অন্যরকম। তারা নিজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল। তারা হয়তবা শহর থেকে গ্রামে অদৃশ্য ঘাতক করোনাকে বয়ে নিয়ে গেছেন। দোয়া করি এমনটা যেন না হয়। তবে লক ডাউন এত দিন চলে আসছে বিধায় এই ধারনাটা মস্তিস্কে এসেছে। তাই বলে ফেললাম। ধনীদের এমন ছুটে চলা দেখে নিন্মবিত্ত শ্রেণীর মন নাড়ির টানে ছুটে গেছে। কিন্তু তারা স্বশরীরে পাড়ি দিতে পারে নাই। গনপরিবহন বন্ধ ছিল। গনপরিবিহন আর ধনুক শ্রেণীর পরিবহনের মধ্যে সত্যিই যে একটা বিস্তর ফারাক আছে এই বিষয়টা এবার বোধগম্য হয়েছে। তবে আর কিছু দিন ছুটাছুটি না করে নিরাপদে নিজস্থানে অবস্থান করাটাই মনে হয়ে উত্তম ছিল। করোনায় মৃত্যুর তালিকা দিন দিন বেশ লম্বা হচ্ছে। একটি লোকের মৃত্যু মানে দেশের একজন অংশীদারের হারিয়ে যাওয়া। কাউকে হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। হোক না সে অচেনা ব্যাক্তি। সে তো মানুষ। বিশ্বায়নের যুগে এসেও আমরা যে কত অসহায় তা প্রকৃতিই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে শুরু করে ব্যক্তি ক্ষমতা, সব কিছুই পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের এই অসহায়ত্বকে রোধ করাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বনেতারাও আত্বসমর্পন করেছে। এই অবস্থায় লক ডাউনের মধ্যে দিয়ে আমাদের জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়াটা মোটামুটি ভাবে ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে গ্রামের বাড়িতে ব্যক্তগত গাড়ি নিয়ে দেশের মানুষের এমন ছুটে যাওয়া দেখে নিরাশায় পতিত হলাম । জীবনের এই ঝুকির চেয়েও আমাদের বেঁচে থাকাটাই হল এবারের ঈদের মূল আনন্দ। সামাজিক দূরুত্ব আর পরিপূর্ন সাবধানতার মধ্য দিয়ে আমাদের আরও কিছু দিন পার করে যেতে হবে। দেখা যাবে এরই মধ্যে ঔষধ আসতে শুরু করেছে। প্রতিষেধক উদ্ভাবন হয়েছে। মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে। সব কিছুই ঠিক ঠাক ভাবে চলছে। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তের শরীরে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দিয়েছে। সফল হয়েছে তারা। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেছেন তারা আরো দশ হাজার লোকের মধ্যে এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এর মধ্যে শিশুরাও থাকবে। হিন্দুস্থান টাইমস বলেছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গবেষনা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপকে এক করে ফেলছে। তার মানে তারা বসে নেই। দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে। এই ঈদে এটিও আমাদের বেঁচে থাকার মত আরেকটি আনন্দের সংবাদ। টানা দু’মাসাধিক ঘরকূনে হয়ে থাকার পর আমাদের আরো কিছুদিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। এই পরীক্ষা হবে আমাদের দু’মাস নিথর হয়ে ঘরে বসে থাকার স্বার্থকতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সাহসের সাথে ধৈর্য ধারন করতে হবে । আমাদের রণসংগীত শুনলে মনে তেজ আসে।ছুটে চলার সহস পাই।কবি নজরুলের জন্ম দিন আমাদের এবারের করোনায় ঘেরা ঈদে আরেকটু সাহস যুগিয়েছে। তিনি তার একটি গানে বলেছিলেন , দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য্য, হে উদার নাথ, দাও প্রাণ। দাও অমৃত মৃত জনে, দাও ভীত –চিত জনে, শক্তি অপরিমাণ। হে সর্বশক্তিমান।। দাও স্বাস্থ্য, দাও আয়ু, স্বচ্ছ আলো, মুক্ত বায়ু, দাও চিত্ত অ–নিরুদ্ধ, দাও শুদ্ধ জ্ঞান। এই ঈদ করোনার ভয়ে চুপসে যাওয়ার ঈদ নয়। বৈষম্যের ঈদ নয়। এই ঈদ হতে হবে আমাদের বেঁচে থাকা মানুষগুলোর শৌর্যের ঈদ ! ঈদ মোবারক।
মোঃমুশফিকুর রহমান লেখক ও সাহিত্যিক