রাহাত এবং রাফিদ দুই ভাই।রাহাত রাফিদের একটু বড়। তাই সে রাফিদকে সব সময় দাদাগিরি দেখায়। কিন্তু মনটা অনেক ভাল। দিনশেষে তাকে বাবা-মায়ের মতোই যত্ম করে রাখে সে।ছোটবেলায় মা-বাবা হাড়িয়েছে তারা। এখন শহরের ফুটপাতের ল্যাম্পপোস্টা আর পথঘাটে হোটেলের বারান্দায় তাদের রাতে মাথা গুজানোর স্থান।সারাদিন কাগজ আর প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে তারা।মাঝে মাঝে মানুষের গাড়িও পরিষ্কার করে তারা।দিন শেষে যা পয়সা পায়। তা দিয়ে ভালভাবেই ক্ষুধা নিবারণ করে তারা। থাকার তো আর তেমন চিন্তা নেই। তাই ভালভাবেই কাটছিল তাদের দিন।কিন্তু বিশ্বের বুকে নেমে আসল এক ভয়ানক মহামারি করোনাভাইরাস।ছড়িয়ে পড়ল তাদেরদেশেও। মহুর্তেই মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। জনজীবন স্থবির হয়ে গেল। লোকজন ঘর বন্দি হতে শুরু করল।শহরগুলোকে লকডাউন করা হলো। দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হলো।কিন্তু তাদেরকে কিভাবে লকডাউন করবে? তাদের তো রাস্তায় ঘর, রাস্তায় বাড়ি। রাস্তায় খেলার মাঠ। তারা দোকান থেকে থ্রি স্টার কিংবা ফাইব স্টার বল কিনে রাস্তায় খেলতে পারে না।পরে থাকা প্রাণ আর পেপসির বোতলই তাদের থ্রিস্টার ফুটবল। এটা দিয়েই তারা মন ভরে খেলে আর প্রাণ ভরে হাসে।মাঝে মাঝে বোতল না পেয় নিজের গায়ের জামাটা খুলে পুটলি করে সেটা দিয়েই খেলতে শুরু করে।খেলা শেষে সেই জামাটায় আবার পড়ে তারা।কোকড়ানো ছিড়ে যাওয়া জামার ভিতর দিয়ে রাফিদ রাস্তার উপরে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাইয়া ঐ দেখ চাঁদ উঠেছে। ঈদের চাঁদ।ভাইয়া এবার আমরা নতুন জামা কিনব না?? রাহাত একটু বিরক্তের সুরে বলে, ভাগ এখান থেকে। আসছে নতুন জামা নিতে!!! লকডাউনে খেতে পাচ্ছে না। আবার নতুন জামা নিবে!! একার ঈদ উপলক্ষে সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুলে দেয়া হলো। মানুষজন কর্মে ফিরতে লাগলো। তারাও তাদের কাজে নেমে পরল।সারাদিন কাগজ আর বোতল কুড়াতে থাকে তারা।সন্ধায় কাগজের ব্যাগ কাঁধে হাটতে হাটতে হঠাৎ লাল টুকটুকে একটা পাঞ্জাবি চোখে পড়ে রাফিদের। একটু কাছে গিয়ে কাঁচের এপার থেকে তাকিয়ে থাকে সে।রাহাত পিছন ফিরে ডাকতে থাকে তাকে।কি রে, দাড়াইছোস কেন? আয়। ভাই রাগ করবে দেখে আর জামার কথা বলতে পারে না রাফিদ। আবার ব্যাগ কাঁধে হাটতে থাকে দুজনে।কিন্তু রাহাত বুঝতে পারে তার চাওয়া।নিরবে দেখে রাখে তার ভাইয়ের পছন্দের সেই লাল টুকটুকে পাঞ্জাবিটি।আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা কর। যে ভাবেই হক এটা তাকে কিনতেই হবে।পরদিন থেকে সে আরো বেশি কাগজ আর বোতল কুড়াতে থাকে। মানুষের গাড়ি পরিষ্কার করে।আর মাঝেমধ্যে দোকানের পাশ থেকে জামাটি দেখে আসে বিক্রি যদি হয়ে যায়!! আবার চলে যায় হোটেলে। সেখানে গ্লাস প্লেট পরিষ্কার করে। খাদ্যের ভেন ঠেলে মালামাল পরিবহন করে।এভাবে দিন শেষে যে টাকা পায়। তাই নিয়ে দ্রুত চলে যায় দোকানে। চরম উৎসাহে জামাটি হাতে নিয়ে টাকা দিতে গেলে। পকেটে আর টাকা খুজে পায় না রাহাত।মুহুর্তেই বকা খেয়ে দাড়োয়ান ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে রাহাত।হতাশায় আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়ে তার মাথার উপর। কত কষ্ট করে টাকাটা জমিয়েছিল সে। কাল ঈদে ভাইকে তার পছন্দের নতুন জামাটি কিনে দেবে বলে। কিন্তু এ কি ঘটে গেল তার সাথে। কিছুই বুঝতে পারেনা সে।দোকানে কেঁদে কেঁদে জামার জন্য অনেক রিকুয়স্ট করে রাহাত।কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হলো না। কষ্টে ভরা বুক আর অশ্রুসিক্ত নয়নে চলে আসল ভাইয়ের কাছে।রাফিদ ভাইয়ের মলীন মুখটি দেখে পাশে এসে বসে বলল, কি হয়েছে ভাই তোমার? কোথায় ছিলে সারাদিন? চোখ লাল হয়েছে কেন তোমার? কে কি বলেছে বলো আমায়? হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করছে রাফিদ। কিন্তু কোন উত্তর নেই। স্তব্ধ চিত্তে মাথা নিচু করে আছে রাহাত।মুহুর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,ভাই আমি তোর পছন্দের লাল পাঞ্জাবিটা আনতে পারিনি রে!! সেদিন তুই যখন রাস্তায় পাঞ্জাবিটার দিকে তাকিয়েছিলি। আমি বুঝেছিলাম তোর ওটা পছন্দ হয়েছে। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। যে করেই হক তোকে ওটা কিনে দেবই। হয়েছিলও তাই। কিন্তু রাস্তায় টাকাটি হারিয়ে ফেলায় আর কিনতে পারলাম না রে পাঞ্জাবিটি।অনেক রিকুয়েস্ট করলাম জানিস? বললাম, ভাই আমি পথে টাকাটি হারিয়ে ফেলেছি। জামাটি কিনার জন্য আজ সারাদিন কাজ করেছি। এটা আমার ভাইয়ের খুব পছন্দের জামা। আমাকে দিয়ে দেন ভাই। আমি ঠিকই পরে টাকাটা দিয়ে যাব। আমার কোন কোথায় শুনলো না ভাই তারা। আমি পারলাম না রে তোকে জামাটি এনে দিতে। মাফ করে দিস আমাকে। মুহুর্তেই রাফিদ ভাইয়ের চোখ দুটি মুছে দিয়ে রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টটির কাছে দাড়িয়ে তার গায়ের জামাটি খুলে উল্ট করে পড়ে ভাইকে বলল,ভাইয়া এদিকে তাকাও। "এই দেখ আমার নতুন জামা। সুন্দর হয়েছে না?" কাঁদছ কেন তুমি? বলে হাসতে হাসতে বলল, চলো বল খেলি।রাস্তার বোতলটি নিয়ে দুজনে আবার বল খেলতে থাকল হাসি মুখে।আর এভাবেই প্রতিবার রাহাত রাফিদদের সপ্নগুলো মুখথুবড়ে পড়ে থাকে রাস্তার উপর।তাই আসুন এবার ঈদে আমাদের আনন্দ টুকু ভাগাভাগি করি তাদের সাথে। হাসি ফুটাতে চেষ্টা করি পথে থাকা সেই রাহাত রাফদের মতো সবার মুখেও।শত কষ্ট ভুলে হাসি মুখে বলতে চেষ্টা করি,
" ঈদ মোবারাক"
রায়হান ইসলাম দর্শন বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়