সোহেল সানি
বাঙালীর জীবনে সর্বাপেক্ষা মহা দুর্যোগ নেমে এসেছিলো ১৭৬৯-৭০ সালে। মোট
জনসংখ্যা চার কোটি। তার এক কোটিই মারা যায়।
দুঃখ-দুর্দ্দশায় নীরবতা এবং অসচেতনতা অবলম্বন করা বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
তবে এ অসচেতনতা বা নীরবতার একদিন ভাঙ্গে, কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকে না।
মরণঘাতী করোনা মহাদুর্যোগ চলছে, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের দৌড়ঝাঁপ।
বাঙালীদের অসচেতনতাই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ফেরা
মানুষের মধ্যে কোনো আতঙ্ক উদ্বেগ আছে বলে মনে হয়না। প্রতিদিন করোনায়
মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু মানুষকে আটকানো যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও
প্রথমে বাধা দিলেও উচ্ছ্বাস দমাতে না পেরে সড়কপথ মুক্ত করে দিয়েছে।
পৃথিবী জুড়েই বাঙালীর মৃত্যুর খবর। সে গণমাধ্যমে উঠে আসছে। তবুও গতিরোধ
করতে পারছে না কারোরই। দলে দলে মানুষের উপচে' পরা ভিড় করোনা পরিস্থিতিকে
আরও বিপথগামী পথে ঠেলে দিচ্ছে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে বাড়ি ছুটছে।
স্থলপথে, নৌপথে হাজার হাজার মানুষের গায়ে গায়ে সমাগম। শারীরিক বা সামাজিক
দুরত্বের আহবানকে কানে তুলছে না। এরাই আবার ছুটে আসবে রাজধানীতে। পরিবেশ
কতটা নিরাপদ থাকবে সেটাই প্রশ্ন। সরকার বার বার সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ
দিয়ে আসছিলো। শেষ মূহুর্তে গতিরোধ করতে না পেরেই হয়তো শক্ত অবস্থান থেকে
সরে দাঁড়িয়েছে।
যাহোক ফিরে আসছি সেই মহা দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে।
ব্রিটিশ লেখক হান্টার ১৭৬৯-৭০ সালের বাংলায় মহা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে
লিখেছেন, মৃত্যুবরণকারী আর ভিক্ষুকের সংখ্যা বর্ণনাতীত। সারা গ্রীষ্ম
কালেই লোক মারা গেছে। ঢাকার আশপাশে উঠেছিলো লাল পানি। সারাদেশ ডুবে যায়
পানিতে। পানি কমে গেলেই শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। আর জল বসন্ত। এক সের চালের
জন্য সন্তান বিক্রি করে দেয়। শহরের লোকেরা চালের বিনিময়ে সন্তান কিনে
নিতো।
এটি বাঙালীর জীবনে সবচেয়ে বড় মহা দুর্যোগ নেমেছিলো। পানি বসন্ত আর না
খেয়ে মারা যায় মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও অধিক। অর্থাৎ শুধু বাংলাদেশ
নয় অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যাই তখন মোটে চার কোটি।
বাংলা সালের হিসাবে ১১৭৬ সালে এ দুর্ভিক্ষের মহা দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ায়
ইতিহাসে এটাকে "ছিয়াত্তরের মনন্তর" বলা হয়।
সেদিনও বাঙালির মধ্যে চরম অসচেতনতা এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের কারণে প্রাণহানি ঘটে।
পলাশী বিপর্যয়ের এক যুগের মুখে এ দুর্ভিক্ষের কবলে পরে দেশ।
পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনীর পরাজয়ে সেদিনও বাঙালীদের মনে বিশেষ কোনো
প্রতিক্রিয়া হয়নি।
"এক রাজা যাবে পুনঃ অন্য রাজা হবে
বাংলার সিংহাসন শূন্য নাহি রবে"
এই ছিলো বাঙালীদের মানসিকতা।
নবাব সিরাজুদ্দৌলার মাথা বিহীন মৃতদেহ যখন মাদী হাতীর পিঠে রেখে
মুর্শিদাবাদের রাস্তায় ঘুরানো হয়, তখন মানুষ করতালি দিয়ে ইংরেজদের স্বাগত
জানায়। আর মনে করতো,
সিরাজ লম্পট, ভীরু ও অমিতাচারী নবাব, যার চারপাশে ভীত কামাসক্তে হারেমের
পেশাদার নতর্কীরা থাকতো।
১৮৭৫ সালে নবীন চন্দ্র সেন "পলাশীর কবিতায় এভাবে নবাবকে চিত্রিত করেন। এর
১৮ বছর পর অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় "সিরাজুদ্দৌলা" গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে
এমন এক প্রয়াসের সূচনা করেন,যেখানে নবাবকে জাতীয় বীর হিসাবে তুলে ধরা হয়।
ইতিহাসের দুঃখ হলো ইতিহাস পড়লেও ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
বাঙালীরাও নেয়নি। বরং
পলাশীর যুদ্ধকে ক্ষমতার হাতবদল হিসাবেই গ্রহণ করে।
পলাশি যুদ্ধে বিজয়ের পর ইংরেজরা হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর।
যাই হোক ১৭৬৯-৭০ এর দুর্ভিক্ষ এক কোটি লোক অনাহারে ও জলবসন্তে মারা যায়।
কৃষিযোগ্য জমির এক তৃতীয়াংশ জঙ্গলে পরিণত হয়।
গৃহস্থরা গরু-ছাগল, লাঙ্গল-জোয়াল বেঁচে দিয়েছে, বীজধান খেয়ে ফেলেছে।
অবশেষে ছেলেমেয়ে বেঁচতে শুরু করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক সময় আর
ক্রেতাও পাওয়া যায় না। তারপর গাছের পাতা, মাঠের ঘাস খেতে শুরু করে, জীবিত
মানুষ মরা মানুষের মাংস খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট
কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই
শুরু হয় সংক্রমক রোগ পানি বসন্ত। প্রাণ চলে যায় লাখ লাখ। শাহজাদা সাইফুত
বসন্তে প্রাণ হারান। মৃত ও মরণাপন্ন লোক স্তুপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে
চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এতো যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও
দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিলো না। মেথর, কুকুর শৃগাল ও শকুনের পক্ষেও এতো
বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিলো না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ
মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে।
আমরা বিশ্বব্যাপী মরণঘাতী করোনা ছোবলে আতঙ্কিত। উৎকন্ঠিত। দেশে দেশে
মৃত্যুর খবর। পৃথিবী ওপর যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তা বলার আর
অপেক্ষা রাখেনা। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ কতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের
সম্মুখীন হবে তা বলা মুশকিল। কোন কোন মহল সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষেরও আশঙ্কা
করছেন।
করোনা কতদিন আর কতপ্রাণ নিবে তার ওপর নির্ভর করছে ব্যবসা বানিজ্য।
নিশ্চয়ই বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে আছে। পরিস্থিতির উত্তরণে সরকার আরও
কার্যকর বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, মানুষের প্রত্যাশা, সত্যি সত্যি
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিবে সরকার।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।