আসছে আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতি বীদদের মতে, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও বাস্তব চিত্রে তা দেশের কোনো কাজে আসে না। দুর্নীতিবাজরা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে আরও উৎসাহিত হয়। তাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পরিবর্তে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্যর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত মনে করেন অর্থনীতিবীদরা
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। কারণ সুযোগ দেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসে না। বরং এই সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে কালো টাকা তৈরিতেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, আমি যেভাবে পারি টাকা উপার্জন করি। কারণ সরকার তো কোনো না কোনো সময় কালো টাকা সাদা করার করার সুযোগ দেবেই।
তিনি বলেন, আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার বিশেষ শর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হযেছিল। তবে সেটা কালো টাকা ছিল না, বরং বৈধ উপায়ে উপার্জিত অপ্রদর্শিত অর্থের কথা বলা হযেছিল।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, আয়কর না দেওয়ার কারণে যে অর্থ অবৈধ হয়ে গিয়েছিল, আমরা কেবল সেই অর্থকেই নিয়মিত আয়করের পাশাপাশি অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা আদায় করে বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিলাম। এতে করে বেশ কিছু টাকা সাদা করা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছরই বাজেটে কম বেশি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং কালো টাকা উপার্জন করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই এটা বন্ধ করা উচিত।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও। তিনি মনে করেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু সেই অযৌক্তিক কাজটিই বছরের পর বছর করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য রাখা উচিত। কালো টাকার মধ্যেও দুই ধরনের টাকা আছে— একটা অনুপার্জিত অর্থ, যেটা চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, ঘুষ, অনিয়ম-দুর্নীতির ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জন করা হয়; অন্যটা একেবারেই অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থ। এই অর্থ সমাজকে কলুষিত করে। ফলে দুর্নীতির এই টাকাকে কোনোভাবেই সাদা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, আরেকটা কালো টাকা হচ্ছে ব্যবসায়ী সম্প্রাদায়ের টাকা। তাদের উপার্জন বৈধ, কিন্তু কোনো কারণে ডিক্লারেশন না দেওয়ায় কিংবা ট্যাক্স না দেওয়ায় টাকাটা কালো হয়ে গেছে। এ ধরনের অর্থকে সাদা করার সুযোগ দিলেও দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাদের আয়টা বৈধ, শুধু ডিক্লারেশন নেই। তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হলেও রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা অন্যদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া যাবে না।
নিজের মতের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাস্তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে তাতে দেশের কোনো লাভ হয় না। বরং দেশের বদনাম হয়। বলা হয়, এই দেশে কালো টাকা সাদা করা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মনে করেন , ঢালাওভাবে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে আমি নই। এতে করে যারা নিয়মিত ট্যাক্স দেন, তারা নিরুৎসাহিত হন। পাশাপাশি কালো টাকা সাদা করার যে নিয়ম বা পদ্ধতিতে রয়েছে, আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা হয় না।
তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার নিয়ম হলো— একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। এর জন্য কেউ কোনো হয়রানি বা প্রশ্ন করবে না— রাষ্ট্রের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের একটা ক্যারট স্টিক থাকতে হবে— সরকারের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কেউ অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন না করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানে নামতে হবে। অভিযানে কারও কাছে কালো টাকা পাওয়া গেলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ জেল-জরিমানার বিধান করতে হবে। এভাবে একবারের জন্য সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
এনবিআরের সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, বর্তমানে যেভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা অনৈতিক। বর্তমানে আইটি ও গৃহায়ণসহ কয়েকটি খাতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া আছে। এগুলোও সঠিক পদ্ধতি না। এতে করে কেউ কালো টাকা সাদাও করছে না, সরকারেরও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং অনিয়মকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।