তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্য খাত। বিদেশেও রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। ২০১৬ সালে বিশ্বে তোলপাড় করা পানামা পেপারসে বিদেশে অর্থপাচারকারী যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম এসেছিল, সেখানেও ছিল তার নাম। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে ১৪টি ঠিকাদার/ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সেখানে নেই তার নাম। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা শক্তিশালী। দুর্নীতি করে শাস্তি তো পানই নি, এমনকি কালো তালিকা থেকেও তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন। এ থেকেই বোঝা যায় তার ক্ষমতা কতটা বিস্তৃত। বলছি, স্বাস্থ্য খাতের গডফাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর কথা।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে লেখা চিঠিতে স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মিঠুর নাম উল্লেখ করেছিলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ঠিকাদার মিঠুর সঙ্গে মিলে কোটি কোটি টাকার যে দুর্নীতি করেছিলেন সে বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক। ঠিকাদার মিঠু বিনা টেন্ডারে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল। অথচ কালো তালিকায় এই মিঠুর নাম নেই। এ থেকেই বোঝা যায় ঠিকাদার মিঠু কতটা শক্তিশালী। কীভাবে এত ক্ষমতাবান হলেন তিনি?
জানা যায়, স্বাস্থ্য খাতের মতো দুদকেও রয়েছে মিঠুর শক্তিশালী একটি চক্র। সরকারের অন্য সেক্টর থেকে প্রেষণে আসা দুদকের এক ক্ষমতাধর পরিচালকের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা। দুদকের এই চক্রই মূলত তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন সাবমিশন’ মামলা করেছিল দুদক। কিন্তু দুদকের ভেতরের ওই চক্রের কারণেই মামলাটি বেশি দূর এগোয়নি।
টাকার পাহাড় গড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি-স্টেনোগ্রাফার আবজাল হোসেনের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে মিঠুর। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিঠু এমন কৌশলে দুর্নীতি করেছেন যে,সেগুলোর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া মুশকিল। পুরো স্বাস্থ্য খাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে।
জানা গেছে, মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচরার মহিপুর ইউনিয়নে। দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনো তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনো হুমকি-ধামকির মাধ্যমে। মিঠুর সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের অনেকের যোগসাজশ রয়েছে। টেন্ডার কারসাজিতে পটু এই সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে সিনিয়র পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসক, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালালকে ব্যবহার করা হয়। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্বান করা হোক না কেন, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন- কাজ তাদেরই দিতে হবে।
জানা যায়, মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন মিঠু। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত। এরপর ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য খাতের উচ্চ পর্যায়ের নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর বেকায়দায় পড়ে যান মিঠু। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে হাত করে ফেলেন। কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে পুরো স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবিভর্ত হন মিঠু। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিনজন পরিচালকও মিঠু সিন্ডিকেটে যোগ দেন বলে জানা যায়।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের উচ্চ পর্যায় তো বটেই নিচের পর্যায়েও মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্য আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালসহ দেশের প্রায় সব বড় হাসপাতালগুলোতেই শীর্ষ কর্মকর্তারা মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য বলে জানা যায়। আর এভাবেই পুরো স্বাস্থ্য খাতটাকে নিজের পকেটে পুরে রেখেছেন মিঠূ।