প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ১:১৭ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ১, ২০২০, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ
দূর থেকে বা'তাসের সাথে ভেসে আসছে জাহজের সাইরেন। কেবিনের টেবিলটা হঠাৎ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে জা'নালার ফা'ক গলে কিনারের কোন আলোক উৎস থেকে আ'সা সল্প আলোতে। এ যেন অন্ধকারকে বুড়ো আঙুল দেখানোর বৃথা চেষ্টা। আলোর সাথে আ'সা কিছুটা ঠান্ডা বা'তাসও শীতল করে রেখেছে কেবিনের পরিবেশ। হঠাৎ করেই কেবিনের দরজায় একটি শব্দ ঠকঠক। দরজা ঘুলতেই সভ্য পোশা'কে আ'বৃত মাঝ বয়সের একটি লোক মুচকি হেসে বলল-
- হ্যালো ম্যাডা'ম। আপনা'র একা'ন্ত সেবায় নিয়োজিত এম ভি আলাউদ্দিন -১ এর ক্যাবিন বয় আমি এনায়েত। আপনা'র কি কিছু লাগবে ম্যাডা'ম?
- হ্যালো। না তেমন কিছু নাহ, তবে এক কাপ কফি পেলে ভাল হত।
- ওকে ম্যাডাম। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আরকিছু ম্যাডাম?
- না, ধন্যবাদ।
মায়ের একান্ত বাধ্য ছেলের মত চলে গেল লোকটি। বিছানার উপর পরে থাকা চাদরটা পেচিয়ে বাইরে বের হল লিমা। কেবিনের দরজাটা টেনে একটু এপাশ ওপাশ তাকিয়ে রেলিং এর পাশে থাকা চেয়ারটার উপর বসে পরলো। কেবিনের ভিতরটা হালকা শীতল থাকলেও বাহিরে বেশ ভাল রকমেরই ঠান্ডা পরছে। চাদরটায় আরো শক্ত করে নিজেকে মুড়িয়ে নিল লিমা। পরিবেশটা বেশ ভালই লাগছে ওর। কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইক নির্বিঘ্নে। এমন সময় কফি নিয়ে হাজির হল লোকটি।
- ম্যাম আপনার কফি।
- ধন্যবাদ।
লিমা হাতে থাকা কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে দেখে তার পাশের কেবিন থেকে বের হয়েছে মারুফ।
-আরে মারুফ ভাই। কেমন আছেন?
মারুফ হঠাৎ থমকে গিয়ে তাকালো লিমার দিকে। মারুফ মোটেও চমকালো নাহ। কারণ সে আগেই দেখেছিল লিমাকে।
- এইতো ভালই আছি। তুমি কেমন আছ?
- হ্যা ভালই আছি। আপনি এই লঞ্চে?
- কেন এই লঞ্চে ওঠা আমার নিষেধ বুঝি।
- না ঠিক তা না, কোথায় যাচ্ছেন?
- বাড়িতেই যাচ্ছি, অফিস বন্ধ। ছুটি পেয়েছি কিছুদিনের জন্য ভাবলাম একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
- আমিতো গিয়েছিলাম আপুর বাসায় ঘুরতে। এখন আপুকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। আপনি দাড়ান আমি আপুকে ডাকছি।
- না থাক পরে দেখা করে নিব। তুমি থাক আমি একটু আসছি।
- আচ্ছা আসবেন কিন্তু। আমরা ৩০৩ নাম্বার কেবিনে আছি।
- আচ্ছা।
মারুফ চলে গেলো। তবে মারুফের মোটেও যেতে ইচ্ছা করছিল নাহ। ওর অবচেতন মন ব্যাকুল হয়ে ছিল রিমা কে দেখার জন্য। রিমাকে এক দন্ড দেখার প্রবল টান ও অনুভব করছে। তবে কেন ও থাকতে পারল নাহ। রিমাকে দেখার এই প্রবল আকাঙ্খাই বা কেন ওকে আটকে রাখতে পারল নাহ। লঞ্চ ছাড়ার পর থেকেই তো সে অপেক্ষা করছিল কখন রিমা কেবিন থেকে বের হবে।
লিমা দৌড়ে গিয়ে কেবিনে ঢুকল। আপা এই আপা,ওঠ না। রিমা ঘুমাচ্ছে।
-রিমা ঘুম ঘুম চোখে বলল কি হয়েছে?
-জানিস এই লঞ্চে কে আছে?
-কে?
-মারুফ ভাই।
নামটা শুনতেই রিমার ঘুম কেটে গেল। এক মুহূর্তের জন্য হতচকিয়ে গেল।
-তুই কোথায় দেখলি?
-আমার সাথে কথা হয়েছে।পাশের কেবিনেই উঠেছে। এখন চলে গেছে তবে একটু পর আবার আসবে বলেছে।
রিমা আবার আগের মত শুয়ে পড়ল। তবে এবার আর ঘুম নেই চোখে। মস্তিষ্কে এবার জেগে উঠেছে মারুফের সাথে কাটানো সেই দিন গুলোর কথা। ভার্সিটি লাইফ থেকেই ওদের দুজনার পরিচয়। পাশাপাশি মহল্লায় ওদের দুজনার বাসা। একদিন রিমা কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখে মারুফ রাস্তার মোড়ে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে দাড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই মারুফ ডাকল ওকে।
-রিমা। এই নাও।
-এতো গুলো ফুল কেন?
-আজ তোমার জন্মদিন তাই। এখানে ১৬ টি গোলাপ আছে।
-১৬ টি কেন? আজ তো আমার বয়স ২২ হয়ে গেছে।
-তোমাকে দেখতে এখনো ১৬ বছরের তরুনীর মতই লাগে তাই ১৬ টি গোলাপ।
রিমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে নাহ। এর মধ্যে মারুফ আবার বলে উঠলো-
-আসলে সত্যি কথা বলতে পকেটে ২২ টি ফুল কেনার টাকা ছিল নাহ। তাই টাকায় ১৬ টা পেয়েছি নিয়ে এসেছি। তবে তোমাকে সত্যি আজ সুন্দর লাগছে একদম ১৬ বছরের সদ্য পূর্ণতার দিকে ধাবিত নারীর মত।
মারুফ রিমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল। রিমা অবাক হয়ে মারুফ কে দেখে। ছেলেটা এমন কেন। ঠিক কি আছে ওর মধ্যে। তবে ও বুঝতে পারে কোন এক অদৃশ্য শক্তি ওকে মারুফের প্রতি টানে। মনের কোন গহীন কোণে হয়ত মারুফ নামের একটা ছোট্ট কুটির আছে। সেই কুটিরই হয়তো ওকে মারুফের প্রতি মুগ্ধ করে রাখে।
লঞ্চের সামনে রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে মারুফ। রিমাকে না দেখতে পারার জন্য প্রবল অস্থিরতা কাজ করছে ওর মধ্যে। নিজের প্রতি প্রবল রাগ হচ্ছে। কেন এতোগুলো বছর ধরেও ও নিজেকে রিমার সামনে মেলে ধরতে পারল নাহ। বার বার বলতে গিয়েও কেন বলতে পারে নাহ রিমাকে নিয়ে ওর ডায়রিতে লেখা সেই চারটে লাইন -
তোমাতেই বাঁধিয়াছি ছোট্ট সুখের ঘর,
সেই ঘরেতেই ছিল বিধাতার সর্বোত্তর বর।
তোমাতেই মিলিয়াছে ধরনীর বুকে স্বর্গসুখ,
সেই পাওয়াতেই ভুলিয়াছি মোর সর্ব দুখ।
মারুফ একটা গন্ধ টের পাচ্ছে। গন্ধটা ওর খুব পরিচিত। গন্ধটা রিমার।
-কেমন আছ রিমা?
-না দেখে কিভাবে বুঝলে আমি?
-আগের জন্মে সরিসৃপ ছিলাম তো তাই গন্ধ শক্তি প্রবল।
-পেচিয়ে কথা বলার স্বভাবটা আর গেল না তোমার।
-তোমার সাথে কথা পেঁচানোর আলাদা একটা স্বাদ আছে তাই। চাঁদের আলোতে তোমাকে দেখতে বড্ড মিষ্টি লাগছে। মনে হচ্ছে প্রকৃতি তার পরম মহীমায় আজ তোমাকে সাজিয়েছে। হয়ত বিধাতা তার সৌন্দর্যটুকু নিঙরে দিয়েছে তোমার মধ্যে।
-হ্যালো স্যার। এই যে আপনার টিকেট।
মারুফের সামনে কৃত্রিম হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে কেবিন বয় এনায়েত। মারুফের ভাবনার অবসান ঘটে। মুহুর্তে উধাও হয়ে যায় রিমার শরীরের গন্ধ। কারণ ও জানে রিমার অবস্থান শুধুই ওর কল্পনায়। ও বুঝতে পারে হয়তো কখনোই ওর সাথে আর কথা হবে না রিমার। হয়তো হৃদয়ের অতল গভীরে স্মৃতি হয়েই সারাটা জীবন থেকে যাবে রিমা। হয়তো রিমাকে ওর না বলা কথাটাই আজ অন্যের ঘরে বউয়ের জায়গাটা দিয়েছে। না বলতে পারা এই কথাটাই রিমাকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। তাইতো আজ একটা দেয়ালের দূরত্বও ওদের মাঝে সৃষ্টি করেছে হাজার ক্রশের দূরত্ব। শত চেষ্টা করলেও সে দূরত্ব পেরিয়ে ওদের আর কাছে আসা হবে নাহ। এভাবেই হয়তো পৃথিবীর ভালাবাসা নামক ডায়রির পাতায় লেখা থাকবে আরেকটি অব্যক্ত ভালাবাসার কথা।