প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ৪:২৬ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০, ১:৩৮ অপরাহ্ণ
৫ শতাধিক বছর আগের চর ফরিদপুর দরগাবাড়ী জামে মসজিদ ও আধ্যাতিক ঘর।
তাপস কর,ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।
বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহত্তর জেলা ময়মনসিংহ। অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার আয়তন ও পরিধি ছিল বিশাল। ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব অঞ্চলের লােকসংস্কৃতি ও পুরাতত্ত্বের অফুরন্ত ভাণ্ডার মোমেনসিং পরগনার মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। তেমনই এই পরনার নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুলতান ও মুঘল আমলের মসজিদ এবং ধর্মীয় স্থাপত্য।
ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ' বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়।
মোমেনসিং পরগনায় ৮০ এর অধিক মোগল আমলের মসজিদ ছিল যা মুসলিম শাসন এবং আফগান সামরিক প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী।
এই জরিপের অগ্রপথিক ও পরিচালক মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, ইতোমধ্যে মোমেনসিং পরগনার সমগ্র গৌরীপুর উপেজলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদের জরিপ সমাপ্ত হয়েছে। এ জরিপে মোমেনসিং পরগনার ৫৫টি মোগল আমলের মসজিদ পাওয়া গিয়েছে যা বারো ভূইয়া আমলের জলদুর্গের নিদর্শন।
তবে সেই সময়ে এক গম্বুজ মসজিদের জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সবচেয়ে বেশি। অনুসন্ধানে তিন গম্বুজ মসজিদ ১০টি, ছয় গম্বুজ মসজিদ ১টি, আট গম্বুজ মসজিদ ২টি এবং গম্বুজ ছাড়া দু'তলা মসজিদ ২টির সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ জরিপে সুলতানী আমলের বহু প্রাচীন মসজিদ-স্থাপত্য এবং কিছুটা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ, মাজার ও আধ্যাত্মিক ঘর পাওয়া গেছে। এইসব অমূল্য স্থাপত্য কীর্তিগুলো তৈরি হয়েছিল তৎকালীন সুলতান ও রাজাদের আমলে। এই পর্বের আলোচনা সুলতান আমলের দরগাবাড়ী জামে মসজিদ ও মসজিদের পাশে একটি আধ্যাত্মিক ঘর নিয়ে।
চর ফরিদপুর ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। শম্ভুগঞ্জ মোড় হতে নেত্রকোনা য্ওায়ার পথে গাছতলা বাজার ও কাশীগঞ্জ বাজার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
গৌরীপুর উপজেলার পার্শ্ববর্তী উপজেলা তারাকান্দা। এটি গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এক সময় এই গ্রামটি একটি নদীর চরের উপর অবস্থিত ছিল।
ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায় যে, হাজার বছর আগে ইসলাম প্রচার করার জন্য ফরিদ আহমেদ (রহ) নামে কোন এক সাহাবা এসেছিলেন, আবার কারো মতে প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহ:) এই নদীর চরে এসেছিলেন যার নামে নামকরণ করা হয় চর ফরিদপুর।
অক্সফোর্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত বিখ্যাত বই The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760 এর তথ্য অনুযায়ি ময়মনসিংহ অঞ্চলের কামরূপ শাসনের অবসান হলে মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করেন। বিশেষত কামরূপ ব্রহ্মপুত্র নদ এবং ভুটানের পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত বলে যাদু, যোজনা এবং যাদুবিদ্যার বিশেষজ্ঞ অনুশীলনকারীদের বসবাস করা এক কল্পিত এবং রহস্যময় স্থান বলে মনে করা হতো।
সিলেট সফরকালে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছিলেন যে এই পাহাড়ের বাসিন্দারা যাদু এবং জাদুবিদ্যার প্রতি তাদের অনুরাগী অনুশীলন এবং অনুশীলনের জন্য খ্যাতিমান।
এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর, আউলিয়া, ফকির ও দরবেশদের বদৌলতে। মুসলিম শাসকরা যখনই কোনো অঞ্চল বা স্থান জয় করেছেন, তখনই তারা সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের সুলতানি আমলের বেশ কিছু মসজিদ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।
মোমেনসিং পরগনার তারাকান্দা উপজেলার চর ফরিদপুর গ্রামে ৫০০ থেকে ৮০০ শত বছর আগে দু’টি প্রাচীন স্থাপনা ছিল। শুধু সাতজন মুসল্লীর জন্য ছোট গোল আকৃতির এক গম্বুজ বিশিষ্ট্য মসজিদ ছিল। বিগত দুইশত বছর ধরে এই ছোট মসজিদে কাউকে নামাজ পড়তে দেখা যায়নি বলে জানা গেছে।
ধারণা করা হচ্ছে ১৭৮৭ এর ভুমিকম্পে নদীগুলোর দিক পরিবর্তনের সময়ে গম্বুজের ৩০ শতাংশ ভেঙ্গে যায়। পানি পড়তে পড়তে জঙ্গল বা ঝোপে পরিনত হয়েছে মসজিদটি। মসজিদের পাশে একটি আধ্যাত্মিক ঘর বা দরগা।
স্থানীয়রা তাদের পূর্ব পূরুষের মুখে এটি গায়েবি স্থাপনা হিসেবে শুনে আসছেন। সংক্ষিপ্ত আকারে এই গায়েবি মসজিদ ও গায়েবি আধ্যাত্মিক ঘর বা দরগা সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হলো।
সুলতান আমলের গায়েবি মসজিদটি ভেঙ্গে বড় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির নাম চর ফরিদপুর দরগাবাড়ী জামে মসজিদ। মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমল থেকে এবং ঐ সময়ে প্রাচীন ছোট মসজিদটির ঝোপঝার পরিষ্কার করে, মসজিদটির সামনে একটি চৌচালা ঘর তৈরী করে মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়। দালান ঘর করার সময়ে প্রাচীন স্থাপনাটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
জরিপকালীন সময়ে একজন বয়স্ক প্রতিবেশী চান মিয়া বলেন, মসজিদটি ছিল গায়েবি কারণ মাটি হতে মসজিদটি যত উচু ছিল, মাটির নীচে ততটুকু বা তার চেয়ে বেশী। মসজিদটি ভাঙ্গার সময়ে মাটির নীচে ১০/১৫ ফুট খনন করে ছোট ছোট আকৃতির ইট সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবুও ইট তোলা শেষ হয়নি। অবশেষে ইট তোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এ থেকে ধারণা করা হয় যে, এক সময়ে বর্ষাকালে দু’টি প্রাচীন স্থাপনার ধারে পানি থাকতো এবং দূর থেকে মনে হতো স্থাপনাগুলি পানিতে ভাসছে।তখন এটিকে ধারণা করা হতো গায়েবি দালান। হাওড়ে ভ্রমণ করলে এ ধরণের দালান চোখে পড়ে। মসজিদের পাশে আধ্যাত্মিক ঘর বা দরগা। দীঘির পাশে এ স্থাপত্য ইমারতটি অবস্থিত। ইমারতটির নির্মাণের সঠিক কোনো সাল বা তারিখ ঐতিহাসিকগণ দিতে পারেননি শিলালিপির অভাবে। কিছুটা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর ইমারত। দূর থেকে অনেকে মন্দির মনে করেন।
সুলতান সিকান্দার শাহ ১৩৬৪ থেকে ১৩৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দশ বছর ধরে তৈরি করান আদিনা মসজিদ। আদিনা মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর সাথে কিছুটা মিল রয়েছে। দু’চালা দু’তালা স্থাপত্যশৈলীর নয়নাভিরাম কারুকার্যে শোভিত ইমারতটির ভিতরের পশ্চিম দেয়ালে ১টি মেহেরাব রয়েছে। সামনের দুটো বরুজে এক সময় হয়তো আলো জ্বালানো হতো। উত্তর ও দক্ষিন দেয়ালে দু’টি জানালা রয়েছে এবং পূর্ব দিকে ১টি দরজা রয়েছে তবে ইমামের পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই। ইমারতটির ভিতরে মাত্র তিনজন নামাজ পড়তে পারবেন। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, এই ইমারতটি কোন মসজিদ নয়। একটি আধ্যাত্মিক ঘর বা দরগা অথবা ১০ মহররম কারবালায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের স্মৃতিসৌধ কাঠামো।
জরিপকালীন সময়ে এক বয়স্ক প্রতিবেশী মো. ইদ্রিস আলী মাস্টার (৯২) বলেছিলেন, দরগাাটি গায়েবি। ইসলাম প্রচার করার জন্য ফরিদ আহমেদ (রহ) নামে কোন এক সাহাবা এখানে এসেছিলেন। দরগাটির ভিতর তিনি সারাক্ষণ নামাজ প্রার্থনা করতেন। দরগাটির সাথে একটা ছোট মসজিদ ছিল। প্রতি শুক্রবারে সাত গ্রামের সাতজন অলিদেরকে নিয়ে তিনি নামাজ পড়তেন ও আলোচনা করতেন।
তিনি বলেন, বাবা-চাচার কাছ থেকে শুনেছেন, দরগাটি ইমাম হোসেনের স্মৃতিসৌধ কাঠামো। তিনি ৮০ বছর আগে ১০ মহররমে দরগাটি সামনে জারী গান ও কান্নাকাটি করতে দেখেছেন।
মান্নত বিষয়ে আরও বলেন, প্রতি শুক্রবারে কমবেশী মান্নতের টাকা আসে। পবিত্র মনে ও পবিত্র অবস্থা কেউ মান্নত করলে, কেউ খালি হাতে ফিরে যায়না। যুবক বয়সে ১ টাকা মান্নত করে তিনি নিজে ফল পেয়েছেন। কোন এক কুস্তিগীর মান্নত করে রুপার মেডেল পেয়েছিলেন। এ রকম কাহিনী নিয়ে মান্নতের অনেক ঘটনা রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে এ দরগাটি দেখাশুনার দাবী জানাচ্ছে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। কোন সূফি, পীর, আউলিয়ার মৃত্যুর হওয়ার শত বছর পর তার স্মৃতি রক্ষার্থে মসজিদ ও দরগা নির্মাণ হতে পারে।
অনেকে ধারণা করছেন, এ মসজিদটি খুব সম্ভবত বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহের রাজত্বকালে নির্মিত। ১৪৯৮ সালে হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময় সমগ্র ময়মনসিংহে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বাংলাদেশের মতো ময়মনসিংহ জেলাতেও ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল মূলত সূফি, পীর, ফকির, অলি ও বুজুর্গদের মাধ্যমে। ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য পীর ফকির দরবেশদের দরগাহ, মাজার অথবা তাঁদের সৃতি বিজড়িত মসজিদ লোকশ্রুতি বিদ্যমান।
এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার হুসেনশাহী পরগণা এবং হুসেনপুর নামক স্থান হুসেন শাহের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। তাছাড়া মৈমনসিংহ গীতিকা যা প্রাচীন পুঁথি ও লোকগাঁথার সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ময়মনসিংহ বলতে এখানে বৃহত্তর ময়মনসিংহ।