পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামে মৌসুমি পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। খেজুর গাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করে সেই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘন ও শক্ত পাটালি গুড় তৈরি করা হয়। খেজুর রস থেকে ঝোলা গুড়, দানা গুড়, পাটালি ও চিটা গুড় তৈরি হলেও ভোজন রসিকরা শীত মৌসুমে পিঠে পায়েস তৈরিতে পাটালি গুড়কেই বেশি মূল্যায়ন করে থাকে। তাই শীতে পিঠা পায়েস তৈরিতে পাটালি গুড় শব্দটি বাঙালির হৃদয়ে অতোপ্রোত ভাবে মিশে আছে।
তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৌষের কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে পাবনার চাটমোহরে পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে গাছিদের। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আঁড় পাড়া গ্রামের মৃত এজাহার মন্ডলের ছেলে মইনুল এবং একই উপজেলার মানিক গ্রামের মৃত মজের প্রামাণিকের ছেলে মকবুল হোসেনসহ কাশেম আলীর ছেলে মনিরুল ইসলাম যৌথভাবে চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের কুমার গাড়া গ্রামে এসে খেজুর গাছের পরিচর্যা, রস সংগ্রহ ও পাটালি গুড় তৈরির কাজ করেন। মইনুল ইসলাম জানান, আমরা পাটালি গুড় তৈরিতে প্রায় পনেরো বছর যাবৎ কাজ করছি। চাটমোহরে সাত বছর ধরে পাটালি গুড় তৈরির কাজ করছি। কুমারগাড়া গ্রামের আবুল মাষ্টারের বাড়িতে থেকে আমরা গুড় তৈরির কাজ করি। প্রতিদিন ত্রিশ জন গৃহস্থের দুই শত চল্লিশটি খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে থাকি।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, তারা পালাক্রমে প্রতিদিন একশত বিশটি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে। একেকজন চল্লিশটি করে গাছ প্রস্তুত করে রসের হাঁড়ি বাঁধতে পারেন। দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছে হাঁড়ি বাধেন। রাত তিনটার দিকে ঘুম থেকে জেগে রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনজন মিলে প্রতিদিন চারশো থেকে চারশো বিশ লিটার খেজুর রস সংগ্রহ করতে পারেন। তারপর সকাল ছয়টার দিকে রস ছেঁকে সেই রস জ্বাল করবার জন্য চাড়ে (জ্বাল দেওয়ার বড় পাত্র) তুলে দেয়া হয়। এভাবে তিনঘণ্টা রস জ্বাল করবার পর গুড় হবার জন্য লাল রং ধারণ করে। এসময় রসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। চারের একপাশ উচু এবং আরেক পাশ নিচু হলে ঘন রস একপাশে চলে যায়। উচু পাশটায় জমে থাকা যৎসামান্য ঘনগুড় বাঁশের কাঠি লাগানো হারপাট দিয়ে কয়েক মিনিট ঘষে তৈরি করা হয় গুড়ের বীজ।
এরপর তা মিশিয়ে দেয়া হয় লাল রসের মধ্যে। আবার পুনরায় কয়েক মিনিট ধরে নেড়েচেড়ে গুড়ের ঘনত্ব বাড়ানো হয়। তখন গুড় বেশ ঘন হয়ে আসে। এ ঘনগুড় বিভিন্ন সাইজের সাচের মধ্যে ঢেলে তৈরি করা হয় পাটালি গুড়। এভাবে প্রতিদিন প্রায় সত্তর কেজি পাটালি গুড় তৈরি করে গাছিরা। প্রতি কেজি পাটালি গুড় বিক্রি হচ্ছে একশো থেকে একশো বিশ টাকা। প্রয়োজনীয় মুলধন না থাকায় উচ্চ মুল্যে জ্বালানি কিনতে পাটালি গুড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া হয় অগ্রিম টাকা। এজন্য তাদেরকে সত্তর টাকা কেজিতে গুড় বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের কাছে। মনিরুল ইসলাম জানায়,কার্তিক মাসে খেজুর গাছের পরিচর্যা করা হয় এবং রস সংগ্রহের উপযোগী করা হয়। অগ্রহায়ণের প্রথমদিকে শুরু হয় রস সংগ্রহ। ফাল্গুনের মাঝামাঝি চলে রস সংগ্রহের কাজ।গাছের মালিককে প্রতিটি গাছের জন্য দুই থেকে তিন কেজি করে গুড় দিতে হয়। স্ত্রী সন্তান বাড়িতে রেখে অনেক দূর এসে কয়েক মাস থাকতে হয় আমাদের।
প্রতিদিন জ্বালানি খরচসহ দুই হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সব বাদে প্রতিদিন আমাদের শ্রমিকের মজুরি চারশো থেকে পাঁচশো টাকা থেকে যায়। গুড় প্রসঙ্গে ডাঃ রুহুল কুদ্দুস ডলার জানান, গুড় হজমে সহায়তা করা এনাজাইমের শক্তি বাড়ায়। আয়রনের ঘাটতি কমাতে পারে। শরীরের হরমোনের সমতা বজায়সহ শরীর গরম রাখতে সহায়তা করে। তবে অতিরিক্ত গুড় খেলে ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে, রক্তের শর্করার মাত্রা বাড়ে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে গুড় তৈরি না করলে তাতে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে এবং সদ্য তৈরি গুড় খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।