পাবনার সাঁথিয়ার ধোপাদহ ইউনিয়নের হলুদঘর এলাকার হিরু মোল্লা (৪৫) এখন অনেক আনন্দিত। দুই পা থেকেও নেই। তবে তার আছে স্ত্রী এবং দুটি ছেলে সন্তান। নেই নিজস্ব কোন বসবাসের জন্য উপযোগী ঘর। এবার এই প্রতিবন্ধী হিরু মোল্লা পাচ্ছে একটি পাকা ঘর। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম জামাল আহমেদ তার দুঃখ দুর্দশা দেখে সরকারি ভাবে এ পাকা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে জানায় হিরু।
সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের হলুদঘর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবার নাম মনি মোল্লা। পাঁচ ভাই ও এক বোন। পৈতৃক সম্পত্তি তো দূরের কথা বাড়ির জায়গাও নেই তার। একটি খুপরি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনো মতে রাত কাটান তিনি। হিরু জানান, জন্ম থেকেই তিনি বিকলাঙ্গ।
অসম্পূর্ণ ও অকেজো এবং লেজের মতো পা দিয়ে হাঁটতে পারেন না। হামাগুড়ি দিয়েই ছোটবেলা থেকে চলাফেরা করেন। যত কষ্টই হোক জীবন যুদ্ধে তিনি থেমে থাকেননি। ১৫ বছর আগে বিয়ে করেন। কিন্তু সংসার জীবনে প্রতিবন্ধিতার দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি। বড় ছেলেটিও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। সে আরও জানায়, বিয়ে করার পর দায় বেড়ে যায়। খরচ বাড়ে কিন্তু আয়ের পথ নেই। তবে ভিক্ষা করে খাবেন না বলে পণ করেন। এলাকার লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে একটি দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন। হলুদঘর বাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে তার ছোট টঙ দোকান। দোকানের সামান্য আয়েই চলে সংসার। দোকানের কাজে ছোট ছেলে তাকে সাহায্য করে।
দোকানে বসেই জানান, হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। তিনি হাত দিয়ে প্যাডেল ঘুরানো একটি ভ্যান বানিয়ে নিয়েছেন। ওই ভ্যান চালিয়েই বাজার করা থেকে শুরু করে অন্যান্য জায়গায় যাতায়াত করেন। কিন্তু ভ্যান থেকে নামার পর তাকে হামাগুড়ি দিয়ে কষ্টে চলতে হয়। শরীরে মাটি লেপ্টে যায় বলে তিনি দোকানে ওঠার পর একটি আলাদা পোশাক পরে নেন। এত কষ্টে সংসারের ঘানি টানছেন অথচ তার চোখে মুখে নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। সদা হাস্যোজ্জ্বল হিরুকে অনেকে ‘হিরো’ বলেও ডাকেন। হিরুর জীবনযুদ্ধ ও সততায় মুগ্ধ তার আশপাশের ব্যবসায়ীরাও। তার অসহায়ত্ব দেখে আশপাশের লোকজন তাকে সরকারি বাড়ি পাওয়ার জন্য উপজেলা সদরে যেতে বলেন। লোকজনের পরামর্শে কিছুদিন আগে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম জামাল আহমেদের কাছে যান। হিরু মোল্লা জানান, সবার কাছে ইউএনও স্যারের প্রশংসা শুনে গিয়েছিলাম। তারপরও তার মতো পঙ্গু মানুষ অফিসের ভিতরে ঢুকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে তার প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল। অনেক কষ্টে দোতলায় ইউএনওর রুমের সামনে যান। সেখানে গিয়ে শোনেন, ইউএনওর রুমে যেতে কারও অনুমতি লাগে না। হিরু বলেন, তিনি তার দুঃখের কথা ইউএনওর কাছে খুলে বলেন। তখন ইউএনও সাহেব তাকে একটি সরকারি পাকা বাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। ধোপাদহ ইউনিয়নের মেম্বার আলহাজ উদ্দিন এবং রফিকুল ইসলাম ফিরোজ জানান, তারা তাকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন। ১৫ বছর আগে এ পঙ্গু মানুষটি বিয়ে করেছেন। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। ইউএনও স্যার তাকে পাকা ঘরের ব্যবস্থা করে একটি ভালো কাজ করেছেন। ধোপাদহ ইউনিয়নের সচিব আব্দুল আলিম জানান, ধোপাদহ ইউনিয়নে দুটি পয়েন্টে সরকারি খাস জমিতে ঘর নির্মাণ হচ্ছে। সেখানে একটি পাকা বাড়ির জন্য হিরু ইউএনও স্যারের কাছে গিয়েছিলেন। ইউএনও মহোদয় তাৎক্ষণিক ভাবে তার জন্য ঘর বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই হিরুসহ অন্য ছিন্নমূলরা সেখানে বসবাস শুরু করতে পারবেন। তেথুলিয়া গ্রামের স্থানীয় এক অধিবাসী আব্দুল খালেক জানান, তাদের এলাকায় খাস জমিতে অসহায়, দরিদ্র ও গৃহহীনরা বাড়ি পাচ্ছেন এতে তারাও খুশি। হিরুর মতো একজন পঙ্গু অসহায় মানুষ বাড়ি পাচ্ছেন, এটা শুনে তারা অনেক বেশি আনন্দিত। নতুন বাড়ি পাওয়ার আনন্দের কথা জানতে চাইলে হিরু হাসেন। তিনি বলেন, ইউএনও স্যারের জন্য দোয়া করি। সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম জামাল আহমেদ জানান, অনেক সুস্থ মানুষ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি অথবা কোনো অনৈতিক পন্থা। সেখানে অন্য দশজনের মতো হিরু স্বাভাবিক শারীরিক গঠন নিয়ে জন্ম নেননি। তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধীরা যে কত কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন তা হিরুকে দেখলে, তার কথা শুনলে বোঝা যায়। তবে এই পঙ্গু হিরু প্রমাণ করেছেন ভিক্ষাবৃত্তি না করেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা যায়।
তিনি সংসারের ঘানি টেনে সারা জীবনেও বাড়ি করার টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন না। তার দুঃখের কথাগুলো শুনে স্বাভাবিক ভাবেই কিছু করতে চেয়েছি। সরকারের কর্মসূচির আওতায় তাৎক্ষণিক ভাবে উদ্যোগ নিয়েছি। হিরুর নামে বাড়ি বরাদ্দের প্রয়োজনীয় কাজ করেছি। তিনি জানান, জমি অথবা বাড়ি নেই সাঁথিয়ার এমন ৩৭২ জন বাড়ি পাচ্ছেন। এ উপজেলায় এ ধরনের বাড়ির সংখ্যা পাবনা জেলার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।