শেরপুর প্রতিনিধি : এক বা দুই বছর নয়। ১২ বছর ধরে শেকলে বন্দি জীবন পার করছে কিশোরী আল্পনা আক্তার (২০)। যে বয়সে ছুটে বেড়ানোর কথা ছিল তার। এখন পায়ে শেকল বেঁধে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে তাকে। আশ্চর্য হলেও সত্য, এমনটি ঘটেছে তার সঙ্গে। মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় শেকলে বন্দি করে রাখছে তার পরিবার। এ ঘটনাটি ঘটেছে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের গুরুচরন দুধনই গ্রামে।
আল্পনার পরিবার জানায়, এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে আল্পনা তৃতীয়। ২০০১ সালে আল্পনার জন্ম হয়। ২০০৮ সালে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে যায় আল্পনা। সেখানে হঠাৎ করেই জ্বর ওঠে তার শরীরে। এরপর থেকেই মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এই মেয়ের। এরপর চিকিৎসা করালেও তেমন কোনো ফল মেলেনি, বরং বাড়তেই থাকে অসুখ। শেষমেশ ২০০৯ সাল থেকে শেকলে বন্দি করে রাখে পরিবার।
আল্পনার বাবা সিদ্দিক আলী বলেন, ‘আমি আমার মেয়ের চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ করেছি। এখন আর টাকা নাই। মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে আমি ১০ শতাংশ জমি, পাঁচটি গরু বিক্রি করেছি। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা ঋণও করেছি। আমার ইচ্ছা থাকার পরও টাকার অভাবে মেয়েকে ভালো কোনো চিকিৎসা দিতে পারছি না।’
আল্পনার মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘সরকার আমাদের একটা ঘর দিয়েছে। সেই ঘরের একটি কক্ষে আল্পনা থাকে। এখন পর্যন্ত আমার মেয়ে কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা পায়নি। আমার মেয়ের যন্ত্রণায় আমি শান্তিমতো খাইতে পারি না, রান্নাও করতে পারি না। অতিষ্ঠ করে ফেলেছে আমাকে।’
গুরুচরন দুধনই গ্রামের বাসিন্দা মোতালেব হোসেন বলেন, ‘আমি অনেক দিন থেকে মেয়েটিকে শেকলে বন্দি অবস্থায় দেখছি। আগে ভালো ছিল। চিকিৎসা ঠিকমতো করায়নি, করালে হয়তো মেয়েটা সুস্থ হতো।’
ওই গ্রামের উসমান গণি বলেন, ‘শুনলাম আল্পনা মেয়েটা একদিন ঢাকায় গেল। সেখানে জ্বর নিয়ে আবার বাড়িতে আসার পর থেকেই মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে। তার বাবা কয়দিন চিকিৎসা করাল কিন্তু ভালো হয়নি। এ জন্য শেকলে বেঁধে রেখেছে। সঠিকমতো চিকিৎসা পেলে হয়তো ভালো হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরত।’
একই গ্রামের বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, ‘আল্পনার বাবা তো গরিব মানুষ। তাদের কিছুই নেই। কিভাবে চিকিৎসা করাবে। একটু জায়গা ও কয়েকটা গরু ছিল সব বেচে চিকিৎসা করিয়েছে। কিন্তু ভালো হয়নি। একবার ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়েছে, এগুলো খেয়ে একটু পাগলামি কমেছিল; পরে টাকার জন্য আর ওষুধও খাওয়াতে পারে নাই। সরকারসহ বৃত্তবানরা যদি সহযোগিতা করে তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে আল্পনা সুস্থ হতে পারে। তবে আল্লাহ যদি চান।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম ওয়ারেজ নাঈম বলেন, ‘আমরা আল্পনার পরিবারের কথা শুনে সরকার থেকে একটি দুর্যোগ সহনীয় ঘর দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভাতা এখনো পায়নি। আমরা শিগগিরই আল্পনার জন্য মাসে মাসে ভাতার ব্যবস্থা করে দিবো। এ ছাড়া তার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কথা বলব। আল্লাহর রহমতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সে। আমরা সার্বিকভাবে আল্পনা ও তার পরিবারের পাশে আছি এবং থাকব ইনশাআল্লাহ্।’
জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম আনোয়ারুর রউফ বলেন, ‘শেকলে বন্দি করে রাখা এটা অমানবিক কাজ। মানসিক সমস্যার চিকিৎসা তো আছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিবো।