পেপার বিক্রি করে চলছে মোখলেছুরের পড়াশুনা। তিন বছর বয়সে বাবা যখন মাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন সংসারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার! ছোট ভাই তখন কোলের শিশু। মা তার দুই পূত্র সন্তানকে নিয়ে ভূরুঙ্গামারী থেকে চলে আসেন নাগেশ্বরীতে তার বাবার বাড়ীতে। সেখানেই ঠাঁই হয় তাদের। দুই সন্তানকে নিয়ে মা তখন চোখে অন্ধাকার দেখছেন। কিভাবে দুই সন্তানের পেটে খাবার তুলে দিবেন।
মোখলেছুরের মা মর্জিনা বেগম জানান, অভাবের তাড়ণায় প্রথমে আশপাশের বাড়ীতে কাজ শুরু করি। তারা যা দিত তাই দিয়ে চাল-ডাল কিনে সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতাম। অনেকে প্রতিদিন টাকা দিতে চাইতো না। এতে আমাদের জন্য খুব কষ্ট হতো। পরে সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে লোকলজ্জ্বা ত্যাগ করে রাস্তায় মাটির কাজে যোগ দেই। যা মজুরী পাই তাই দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি বড় ছেলে মোখলেছুরকে স্কুল পাঠনো শুরু করি।
মোখলেছুর জানায়, বাবাকে ছেড়ে মা যখন নানা বাড়ীতে আসে তখন আমি তিন বছরের শিশু। শুধু মায়ের চোখে কান্নাই দেখেছি। বাবা কখনোই আমাদের খোঁজখবর নিতো না। মা বলতো যতই কষ্ট হোক লেখাপড়া ছেড়ে দিও না। আমি যখন ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন বুঝতে পারি আমার মা অসুস্থ্য হয়েও আমাদের জন্য কাজে যেতো। রাতে ব্যাথায় ঘুমাতে পারত না মা। পরদিন অনেক কষ্টে বাড়ী থেকে বের হতো। বুঝতাম আমার পড়াশুনা চালাতে গিয়ে মায়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। তখন আমি মাকে বুঝিয়ে কাঠমিস্ত্রির যোগালি হিসেবে শ্রমের কাজে যোগ দেই। তখন অনিয়মিতভাবে পড়তাম। দুই বছর আমি এই কাজ করি। এরপর যখন ৭ম শ্রেণিতে উঠলাম তখন মা আরো অসুস্থ্য হয়ে পরল। তখন আমি এক প্রতিবেশীর সহযোগিতায় পেপার বিক্রির কাজ শুরু করি। এই কাজ আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। কিছুটা টানাপোড়ন থাকলেও এখন আমি আমার মাকে আর কাজ যেতে দেই না। আমি মাকে দেখাশুনা করার পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছি।
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পৌরসভাস্থ ৩নং ওয়ার্ডে রুইয়ারপাড় এলাকায় ছোট ভাই আর মাকে নিয়ে বসবাস করছে মোখলেছুর। মামারা মায়ের জন্য আলাদা একটা বাড়ী করে দিয়েছেন। সেখানেই চলছে মোখলেছুরদের টানাপোড়নের জীবন। সে এখন পেপার বিক্রির পাশাপাশি নাগেশ^রী কেরামতিয়া বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে। মোখলেছুরের স্বপ্ন সে বড় হয়ে গর্বিত নেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে দেশসেবা করবে।
মোখলেছুর আরো জানায়, পেপার বিক্রি করে প্রতিদিন আমি তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা পাই। সেই টাকা দিয়েই চলছে আমাদের তিনজনের সংসার। মাকে দেখে শিখেছি কারো কাছে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে দুই টাকা রোজগার করা শান্তির। তাই কষ্ট করে রোজগার করে খাচ্ছি। কারো কাছে হাত পাতছি না। আমরা পরিস্থিতির শিকার। আমাদের লড়াই করেই বাঁচতে হবে।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি এডভোকেট আহসান হাবীব নীলু জানান, পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে সেটা সন্তানদের উপরও প্রভাব পরে। সংসারে যোগান দিতে অনেক সময় তাদের শ্রমের কাছে নিয়োজিত হতে হয়। তারপরও বলবো মোখলেছুর নিজের দৈন্যতার কথা কাউকে না জানিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আমাদের উচিৎ মোখলেছুরদের মত অদম্যদের পাশে দাঁড়ানো।