আর তো কাঁদতে পারি না। চোখে পানি নেই। ১১ বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আর কত?বড় আশা নিয়ে দেশে আসছিলাম। মেয়েটার বিয়ের করিয়ে দেশে রেখে যাবো।কিন্তু সেই আশা স্বপ্ন এক নিমিষেই শেষ করে দিলো।ওরা আমার মেয়েকে পাখির মত গুলি করে মারলো।ঘুমের ঘোরে এখনো আমি আমার মেয়ের চিৎকার শুনতে পাই।ও স্বপ্নে আসে।কান্নায় আমার বুক ফেটে যায়।সারা রাত আর ঘুমাতে পারি না।এভাবে কথাগুলো বলেছিলেন ফেলানীর মা জাহানারা বেগম ও বাবা নূর ইসলাম।
ফেলানীর বাবা মা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের বাসিন্দা।শুধু মাত্র জীবিকার জন্য পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতের আসাম রাজ্যের বোয়াইলপাড়া জেলার বঙ্গাইগাও এলাকায়। ভারতে থাকাকালীন কিশোরী ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে। ২০১১ সালে ৭ জানুয়ারী বিয়ের উদ্দেশ্যে বাবার সঙ্গে ভারত থেকে দেশে আসার সময় কিশোরী ফেলানীকে ভারতীয় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মইয়ের উপরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে কাঁটাতারে উল্টোভাবে ঝুঁলে পড়ে যায় ফেলানী। এসময় ফেলানীর বাবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেমে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। প্রায় আধা ঘণ্টা ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ফেলানী। সকাল পৌনে ৭টা থেকে নিথর দেহ কাঁটাতাঁরের উপর ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা ধরে। করুণ এই দৃশ্য গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এরপর বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিএসএফের কোর্টে স্বাক্ষী দেন ফেলানীর বাবা ও মামা হানিফ। পরের মাসে ৬ সেপ্টেম্বর আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিএসএফের বিশেষ কোর্ট। রায় প্রত্যাখান করে পুনরায় বিচারের দাবি জানান ফেলানীর বাবা। পরের বছর ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে স্বাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা। ২০১৫ সালের ২ জুলাই এ আদালত পুনরায় আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষ আবারও বেকসুর খালাস পায়। এই রায়েও সন্তুষ্ট হতে না পেরে ওই বছর ১৪ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ‘মাসুম’ ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রীম কোর্টে রিট পিটিশন করে। ওই বছর ৬ অক্টোবর রিট শুনানী শুরু হয়। ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কয়েক দফা শুনানী পিছিয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনা শুরুর আগে শুনানীর দিন ধার্য হলেও শুনানী হয়নি এখনও। এদিকে মেয়ের হত্যাকারীর বিচার না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন ফেলানীর পরিবার
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, আর তো কাঁদতে পারি না। চোখে পানি নেই। ১১ বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আর কত?
তিনি বলেন, ফেলানী হত্যার পর যেভাবে দেশ ও বিশ্বের মানুষ এগিয়ে এসেছে। আবারও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিচারের জন্য রাস্তায় নামতে হবে। তবে হয়তো আমি বিচার পাব।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, মেয়ে হারাইছি। এখন পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারছিনা। ছেলেমেয়ে বড় হইছে। পড়তেছে। অনেক খরচ। আমাদের দিকে সরকার যেন নজর দেয়। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। বিচারটা হোক দ্রুত এটাই চাই।’
রামখানা ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বলেন, ‘ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার হলে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের নির্যাতন ও হত্যা কিছুটা হলেও কমত। শুরুতে বিচারের কার্যক্রমে আমরা আশা দেখছিলাম। কিন্তু দুইবারের পক্ষপাতের রায় আমাদের বিস্ময় হয়েছি। এরপর সুপ্রিম কোর্ট রিটটি ঝুলে রেখেছে।’
এদিকে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দুদেশের সীমান্ত আইন আছে। কেউ সেই আইনের ব্যতয় ঘটালে আইন মোতাবেক বিচার হওয়া উচিৎ। গুলি করে মানুষ হত্যা বা নির্যাতন আইনের পরিপন্থি। দুই দেশের সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি হতে পারে ফেলানী হত্যার বিচারের সুষ্ঠু রায়ের মধ্য দিয়ে।
পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ফেলানীর রক্ত বৃথা যায়নি। ফেলানী হত্যার আগে সীমান্তে ট্রিগার ফ্রি ছিল। এখন বিএসএফ গুলি করলে জবাবদিহিতার মুখে পড়ে। আগে যেমন নিত্য খুন-খারাপি ছিল সেটা কমে এসেছে। এটা একটা আমাদের প্রাপ্তির জায়গা বলে মনে করি। কিন্তু ফেলানী হত্যা ঘিরে ন্যায় বিচার পাইনি, আমরা সেটার অপেক্ষায় আছি।