সোহেল সানি,
‘করোনা’ নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতী। এটা সৃষ্টি করেছে নানাধরনের, ভয়, আতঙ্ক যা মনের সংক্রমণও ।
শরীরের সংক্রমণ দূর
করার উপায় চিকিৎসা পদ্ধতি দ্বারাই করতে হবে, কিন্তু আত্মপ্রত্যয় জিনিসটা তো
নিজেকেই গড়তে হবে।
করোনায় আক্রান্ত হয়েও যারা সুস্থ হয়েছেন, তারা মূলত, ভয়কে
জয় করেছেন।
তারা সর্বত্র সবসময় স্বচ্ছন্দ সপ্রতিভ-নিজেদের
আত্মপ্রত্যয় সংগ্রহ,
সঞ্চিত ও বর্ধিত করেছেন। চিকিৎসকদের মতে, চিকিৎসা পদ্ধতি আত্মপ্রত্যয় গড়ে তুলতে
পারে না। যখন অন্যসব কিছু ব্যর্থ হয় তখন শুধু সুতীব্র লক্ষ্য মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
ট্যুলেন ইউনিভার্সিটির
স্কুল অফ মেডিসিনের ডঃ জর্জ ই. বার্চের মতে, “সবচেয়ে দ্রুত মৃত্যুর পথটি হলো হতাশ হয়ে কিছুই না করা।
তাঁর এক ক্যান্সার রোগী মিসেস ডি।
তার ক্যান্সার ধরা
পড়ে তার ছেলের বয়স যখন মাত্র দুবছর। আরও হতাশাজনক অন্ধকারময় হয়ে উঠে যখন তার রোগ নির্ণয়ের মাত্র তিন মাস আগে
তার স্বামীর মৃত্যু হয়।
আমরা ডাক্তাররা আশার আলো দেখাতে পারিনি। কিন্তু মিসেস ডি কিন্তু
হাল ছাড়েননি। উনি জীবীকার
জন্য কঠোর পরিশ্রম করে ছোট্ট ছেলেটাকে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন- দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ
হলেন। বেশ কয়েকবার তার শল্য চিকিৎসা করা হয়।
প্রতিবারই আমরা
বলতাম, ‘মাত্র কয়েক মাস বাঁচবেন।’ ক্যান্সার সম্পূর্ণ সারেনি। তবে ঐ কয়েক মাস
বেড়ে দীর্ঘ ২০ বছর হয়েছিলো। মিসেস ডি ঠিকই ছেলের কলেজ পাস করা দেখে গিয়েছিলেন।
সুতীব্র বাসনার এতো শক্তি ছিলো যে তার মৃত্যুকে দুদশক যাবৎ ঠেকিয়ে রেখেছিলো।
পৃথিবীর কোনো ওষুধই দীর্ঘ জীবন পেয়ে বেঁচে থাকার তীব্র বাসনার মতো শক্তিশালী নয়।
‘করোনা’ ভয়- অনিশ্চয়তা, হতাশা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, লজ্জা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
‘হাউ টু লিভ্ ৩৬৫ ডেজ্ এ ইয়ার’ ডঃ শিল্ডারের একটি গ্রন্থ। এটি পড়ে পড়ে একটি একটি করে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম। আর প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেনো ভেসে উঠছিলো, প্রাণঘাতী করোনায় নিহত আপন মুখগুলোর প্রতিচ্ছবি।
যার মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সহকর্মীর মৃত্যু যেমন আমাদের
শোক বিহ্বল করেছে, ঠিক তেমনি আবার আমাদের অদম্য সাহস ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন-বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সম্পাদক করোনাকে পরাস্ত করে।
ডঃ শিন্ডলার বিভিন্ন রোগভোগ নিয়ে কিছু চমকপ্রদ ঘটনার অবতারণা করেছেন।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এক
উকিল বন্ধুর কথা উল্লেখ করে
তিনি লিখেছেন, তাঁকে নাকি ওই বন্ধু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে
এই মর্মে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যে, ‘মৃত্যুর আগে মরবো না।’ ৭৮ বছর বয়স্ক ও
ই বন্ধুটি শেষ জীবন দর্শন হলোঃ “মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকবো। জীবন ও
মৃত্যু দুটিকে দুটিতে গুলিয়ে ফেলবো না।
যতদিন এই পৃথিবীতে আছি, আমি বাঁচতে চাই। আধ মরা হয়ে
বাঁচবো কেনো? একটা মিনিটও মৃত্যু হয়ে কাটানোর মানে সেই এক মিনিট আমি মৃত,
আমি ঐ মূহুর্তে বেঁচে নেই।” আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে আইন ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পারিবারিক জীবনযাপন ও জীবনকে উপভোগ করার
পথে ক্যান্সার কখনই বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।
ক্যান্সারের সেই
রোগীটি ৭৮ এর সঙ্গে আরও ১৯ বছর যোগ করে ৯৭ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ডঃ
একটা প্লেনে চড়ার কাহিনী তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে-প্লেন টেক অফ করার পর
, টিক্ টিক্ আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোকটির দিকে
তাকালাম, আওয়াজটা সেদিক থেকেই আসছিল।
প্রসন্ন হেসে ভদ্রলোক বললেন, ‘ভয় নেই, বোমা নয়, এটা
আমার হার্টের আওয়াজ।’ ২১ দিন আগে ওর একটা অপারেশন হয়, বুকে একটি
প্লাস্টিকের বাল্ব বসানো হয়েছে।
এই কৃত্রিম বাল্বের চারদিকে নতুন
কোষ তৈরি হওয়া
পর্যন্ত বেশ কয়েকমাস টিক্ টিক্ আওয়াজ শোনা যাবে। লোকটি বললেন,
‘আরে আমার দারুণ সব পরিকল্পনা আছে।
মিনেসোটায় ফিরে
আমি আইন পড়বো, ডাক্তার
বলেছেন প্রথম কয়েকমাস সাবধানে থাকতে হবে, তারপর একদম নতুন মানুষ হয়ে উঠবো।’ তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষই রোগ নিয়ে আক্ষেপ করে নিজেকে অর্থব করে ফেলে।
একাধিক ডায়াবেটিসের রোগীর উদাহরণ টেনে বলেন, একজন রোগী ডায়াবেটিস যদিও যৎসামান্য তবুও সে প্রায় অর্ধমৃত।
আবহাওয়া পরিবর্তনের ভয়ে প্রায় সব সময়ই সে আপাদমস্তক নিজেকে
ঢেকে রাখে। সংক্রমণের ভয়ে সে সামান্য সর্দিকাশির লক্ষণ দেখলেই সেখান থেকে
পালায়। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ভয়ে সে কিছুই কাজ করে না। তার সমস্যাটা
‘কি যে ভয়ংকর’ সেটা বোঝাতে গিয়ে অন্যদের অতিষ্ঠ করে তোলে।
এই ভদ্রলোকটির আসল রোগ কিন্তু ডায়াবেটিস নয়।
এক্মকিউসাইটিসের রোগী।
পাশাপাশি আরেকজন ভদ্রলোকের কথা উল্লেখ করে ডঃ শিন্ডলার বলেন, এই লোকটির রোগ
সত্যিই কঠিন ও দুরারোগ্য। উপরোক্ত
ভদ্রলোকটির তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ইনসুলিন নেন তা সত্ত্বেও রোগ তাকে জব্দ করতে
পারে না। কাজ উপভোগ করা, আনন্দ করার জন্য ইনি বেঁচে আছেন।
আমাকে একদিন বললেন, ‘অসুবিধা তো হয়ই, তা দাড়ি কামানোটাও তো বিরক্তিকর। তাই বলে বসে শুয়ে, দুশ্চিন্তা করে জীবন কাটাবো নাকি? যখনই ইনসুলিন নিই, তখন ইনসুলিনের আবিষ্কারকারককে ধন্যবাদ জানাই।
এক্মকিউসাইটিস নিরাময়ে উপায় সম্পর্কে বলেন, রোগের ব্যাপারে তা যদি
জ্বর,
সর্দিকাশিও হয়, যত আলোচনা
করবেন ততই গুরুতর হয়ে উঠবে।
অসুস্থতার ব্যাপারে কথাবার্তা বলা অনেকটা আগাছায় সার দেয়ার মতো।
সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত
মেয়োকিল্লনিক থেকে অবসর
নেয়া ডঃ ওয়াল্টর আলভারেজ লিখেছেন, “আমি সব সময়ই দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের
চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। যেমন এক ভদ্রলোক
দেখা করতে আসেন-
ইনি দৃঢ় নিশ্চিত যে তার পিন্ড কোষ
রোগাক্রান্ত যদিও আটটি ভিন্ন
ভিন্ন এক্সরে তার বদ্ধধারণাকে ভুল প্রমাণ করে।
আমি তাকে
অনুরোধ করি পিন্ডকোষের আর এক্মরে যে না করান। হাজার হাজার হার্টসচেতন মানুষকে আমি ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম করাতে নিষেধ করি।
‘ অসুস্থ বোধ করার অবিরাম
নালিশ বন্ধ করুন, যেমনটি আছেন তাতেই সুখী হন। এই ভালোবোধ
নতুন ব্যথা বেদনা ও ব্যাধি থেকে সুরক্ষিত রাখবে।
নিজেকে প্রায় মনে করিয়ে দিন, ‘মরচে ধরার চেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া ভালো।’ হাসপাতালে শয্যাশায়ী পড়ে আছেন এ কথা কল্পনা
করে বাঁচতে ভুলে যাবেন না।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।