২০১৩ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে জনসভা শেষে পাবনা-ঢালারচরের মধ্যে ৭৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের অধীনে নির্মিত হয় ১০টি নতুন স্টেশন। ছোট-বড় ৯১টি সেতু নির্মাণ করা হয়। আছে ৬০টি লেবেল ক্রসিংসহ আরও স্থাপনা।
২০১৮ সালের ১৪ জুন প্রকল্পের একাংশ (ঈশ্বরদী থেকে পাবনা জেলা সদর) ৩০ কিলোমিটার রেলপথ চালু হয়। রাজশাহী-পাবনা পথে কআগে থেকে চলা ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের চলাচল শুরু হয়। পুরো কাজ শেষে গত ২৫ জানুয়ারি ঢালারচর পর্যন্ত চালু হয়। পাবনা এক্সপ্রেসের নাম পরিবর্তন করে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ নাম নিয়ে চলাচল শুরু করে। করোনা পরিস্থিতি শুরু হলে মার্চের শেষ সপ্তাহে এর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২৭ আগস্ট থেকে পুনরায় ট্রেনটি চালু হয়েছে। সম্প্রতি পাঁচটি স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘ পাঁচ মাসের বন্ধে ধুলাবালু আর মাকড়সার জাল তৈরি হয়েছে স্টেশনগুলোতে। পাবনা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে ও প্ল্যাটফর্মে জমে আছে ছাগলের মলমূত্র। মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ছাগল ছানা। প্ল্যাটফর্মে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন স্থানীয় কিছু তরুণ। দেখা মেলেনি কোনো রেলের কর্মকর্তার।
একজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। পাবনা থেকে সোজা ঢালারচর স্টেশনে গিয়েও প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও একজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। তবে এই দুই স্টেশনের মাঝের বাঁধের হাট, দুবলিয়া, চিনাখড়া ও রাঘবপুর স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীও ছিলেন না। অরক্ষিত স্টেশনগুলোতে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল নিয়ে মহড়া দিচ্ছিলেন স্থানীয় যুবকেরা। বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল শিশু, কিশোর, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ।
পাবনা স্টেশনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাবিলদার আব্দুস সামাদ বলেন, নতুন রেলপথের ১০টি স্টেশনের মধ্যে শুধু পাবনা ও ঢালারচর স্টেশনে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। তাও প্রতি স্টেশনে আছেন চারজন করে কর্মী। প্রতি ৮ ঘণ্টা পর পর একজন করে কর্মী দায়িত্ব পালন করেন। একজন নিরাপত্তাকর্মী পুরো স্টেশন দেখেন। একার পক্ষে এত বড় স্টেশন দেখভাল করা কঠিন। দুবলিয়া ষ্টেশনে বুকিং টিকিট বিক্রির দায়িত্বে নিয়োজিত হেলাল হোসেন বলেন, এখানে কোনো ষ্টেশন মাস্টার নেই। নেই নিরাপত্তাকর্মী। তিনিসহ তিনজন পালা করে দায়িত্ব পালন করেন।
রাতে স্থানীয় বখাটেরা ষ্টেশনে ভিড় করে। সম্প্রতি এক বখাটে টিকিট কাউন্টারের কাচ ভেঙে ফেলেছে। রেলের পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) ফুয়াদ হোসেন বলেন, নতুন এ রেলপথের জন্য নতুন কোনো পদ মঞ্জুর হয়নি। অল্প কিছু স্থায়ী এবং ৩৬ জন কর্মী দিয়ে ১০টি স্টেশন চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি এক রাতে টেবুনিয়া ষ্টেশনে কয়েকজন বখাটে এসে মদ্যপানের চেষ্টা করেছে। ষ্টেশনের কর্মীরা তাদের বাধা দেওয়ায় দরজা-জানালা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
তবে নতুন লোকবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। (যাত্রী ও আয় কেমন)২০১৮ সালে পাবনা এক্সপ্রেস চালুর পর ৬ মাসে মোট ৯৩ হাজার ৬৩৫ জন যাত্রী বহন করে। আয় হয় ৫৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে যাত্রী পরিবহন করে ২ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৯ জন। আয় হয় ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। চলতি বছর করোনাভাইরাসের বন্ধের আগপর্যন্ত ঢালারচর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ট্রেন চলেছে তিন মাস।
এই সময়ে যাত্রী পরিবহন করেছেন ৪৭ হাজার ৩৭৬ জন। আয় হয়েছে ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। রেলের পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. শাহীদুল ইসলাম বলেন, একটি নতুন রেলপথ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় তৈরি হয়। এই রেলপথ নিয়ে সরকারের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। লোকবল নিয়োগ ও নতুন ট্রেন এলে সেবা বৃদ্ধি পাবে।
(যা যা হতে পারে) নতুন এ রেলপথ চালুতে রেল কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, রেলপথটি আঞ্চলিক সংযোগ ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের বিকল্প রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ভবিষ্যতে পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণ করা হলে রেললাইনটি রাজবাড়ী ও ভাঙা হয়ে পদ্মা সেতুর রেল লিংকের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
এতে ঢাকার সঙ্গে বিকল্প যোগাযোগ স্থাপিত হবে। অন্যদিকে মানিকগঞ্জ জেলা রেলের আওতাভুক্ত করা যাবে। এ ছাড়া রেলপথটি পাবনা জেলা সদর, সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলাকে রেল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করেছে। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ, ব্যবসা ও চাকরি করেন। কাজের সন্ধানে ও চিকিৎসাসেবার জন্য তাঁদের পাবনা-রাজশাহী যেতে হয়।
পাবনা জেলার প্রবীণ আইনজীবী জহির আলী কাদেরী প্রথম আলোকে বলেন, পাবনা জেলা কৃষি ও শিল্পসমৃদ্ধ। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি রেল সেবা না থাকলে নতুন এই রেলপথের কোনো যৌক্তিকতা নেই। রেলপথটিতে ঢাকা রুটে ট্রেন চালু এবং মানিকগঞ্জের আরিচা-রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও পাবনার কাজীর হাট পর্যন্ত ওয়াই টাইপ সেতুর দাবিতে আন্দোলন করছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি আ স ম আবদুর রহিম।
তিনি বলেন, জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে শুধু ঈশ্বরদী, চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়ার অল্প কিছু মানুষ ট্রেন-সুবিধা পাচ্ছে। বাকি ছয় উপজেলার মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নতুন রেলপথে ঢাকামুখী ট্রেন দেওয়া হলে পুরো জেলা এর সুবিজধা পাবে।