উত্তরাঞ্চলের চলনবিলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুলের সমারোহ। সরিষা ফুলের মাঠগুলো যেন হলুদ গালিচায় মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে ফেলেছে প্রকৃতি তার রূপ। প্রান্তজুড়ে উঁকি মারছে সরিষা ফুল। শিশির ভেজা শীতের সকালে সোনাঝরা রৌদ্রে ঝিকমিকিয়ে উঠছে সরিষা ফুলের ক্ষেত। বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছিদের ব্যস্ততা যেন মধু সংগ্রহে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য সহজেই হৃদয় কেড়ে নিচ্ছে প্রকৃতি প্রেমীদের। শীতের মৌসুমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌ’চাষীরা। ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স বসিয়ে করে কৃত্রিম আকারে মধু সংগ্রহ করছেন তারা। এর মাধ্যমে অনেকের দুর হয়েছে বেকারত্ব।
চলনবিলের সরিষার মধু বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি। চাক বানাচ্ছে কাঠের বাক্সে। সেখানেই মিলছে উন্নত মানের সরিষা মধু। মৌচাক মধুতে পুর্ন হয়ে গেলে সেখান থেকে মধু বের করে আনা হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চলনবিল এলাকা মধু উৎপাদনে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। মধু উৎপাদনে চলনবিলে এক নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচিত হয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মৌসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে প্রায় ২.৫ হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মৌ’চাষীরা। চলনবিল অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কলম গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, এ অঞ্চলে সরষের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মৌসুমি মৌ’চাষীদের তৎপরতা। সরষে যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ ছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈব সার। ফলে কৃষকরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
ইউরোপিয়ান হাইব্রিড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিল এলাকা। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি বসছে সরিষা ফুলে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে মৌমাছির দল ফিরছে মৌ’বাক্সে। সপ্তাহ খানেক আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৭ শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌ’খামারী চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছেন। সরিষা ক্ষেতের পাশে প্রায় ৫০ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন তারা।
উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতির সভাপতি পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুণ মৌবাক্স এসেছে। মধু উৎপাদনে চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌ’চাষীরাই লাভবান হচ্ছেন তা নয়; মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষা ফুলে পরাগায়নও ঘটছে। এতে উৎপাদন বেড়ে গেছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. তাহমিনা হক জানান, অতীত কাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে।
মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ, যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুদ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মধুতে রয়েছে ফলশর্করা ৩৮.২ ভাগ, গ্লুকোজ ৩১.৩ ভাগ, মালটোস ৭.১ ভাগ, সুক্রোজ ১.৩ ভাগ, পানি ১৭.২ ভাগ, উচ্চ চিনি ১.৫ ভাগ, ছাই ০.২ ভাগ, খনিজ পদার্থ আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, সোডিয়াম ক্লোরিন, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে ৩.২ ভাগ। এ ছাড়া মধু ভালো শক্তিবর্ধক বলেও জানান তিনি ।