‘দাঁতের পোকা ফালাই। কোমর ব্যথা, বাত ব্যথায় শিঙ্গা লাগাই। যাদু দেখাই। সাপ খেলা দেখাই। খা-খা-খা বখখিলারে খা, কাঁচা ধইরা খা।’ – প্রচলিত এ কথাগুলো নদীতে ভাসমান যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের। সুর ও ছন্দ মিশ্রিত এ কথাগুলোই জানান দিচ্ছে বেদেদের উপস্থিতি। শীতের মৌসুমে ক্ষেতের ধান পাকা শুরু হলেই জীবিকার উদ্দেশ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ভাটির দেশের বিভিন্ন এলাকার নদী তীরে বিচিত্র রঙ ও বাহারি ঢঙের ছোট ছোট নৌকার বহর নিয়ে নোঙর ফেলে বেদে সম্প্রদায়।
ওদের অনেককেই আবার সড়ক পথে এসে নদী তীরে বাঁশের চেরা ও পলিথিনের সাহায্যে অস্থায়ী ছোট ছোট ডেরা বেঁধে খুপরি ঘরে ঘাঁটি গেড়ে থাকতে দেখা যায়। রাতের বেলা কারো ঘরে সোলার বাতি আবার কারো ঘরে চার্জার লাইট ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ সময় কৃষকের ঘরে ঘরে গোলা ভরা চাল ও হাতে থাকে টাকা। তাই এ সময়ে এ অঞ্চলে বেদেদের ব্যবসা হয়ে ওঠে জমজমাট। এ কারণেই শীতকালে ওরা আসে ভাটির দেশে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বেদেদেরকে বাইদ্যা বা বাইদানী বলে ডাকে। কেউ কেউ আবার ওদেরকে বাদিয়া কিংবা জলের জিপসি বলেও ডাকে। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ নিয়েই শত শত বছর ধরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে ওরা আজও টিকে আছে।
আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার ধার ধারে না ওরা। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে বেদে সমাজের প্রচলিত ব্যবসাকেই ওরা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। শত কষ্টের মাঝেও এতেই যেন ওরা সমস্ত সুখ খুঁজে পায়। বেদে সমাজের নারীরাই সংসারের মূল চালিকাশক্তি। নারীরা দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত। নারীরা রোগের জন্য মানুষের কাছে তাবিজ, কবজ, ওষুধ, কড়ি বিক্রি করে এবং মানুষকে যাদু ও সাপ খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। আর পুরুষরা পাখি শিকার করে এবং সাপ ও মাছ ধরে অর্থ উপার্জন করে। এ ভাবেই বেদেরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কুসংস্কার ও উদাসীনতার কারনে বেদেরা শিক্ষার আলো ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্ধকারেই পড়ে থাকে। ফলে সচেতনতার অভাবে বেশির ভাগ সময়েই ওরা স্বাস্থ্যহীণতায় ভোগে।
এমনকি অনেক সময় ওদের কেউ কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণও করে। শিক্ষার আলো না থাকায় বাইরের জগত থেকে ওরা আলাদা। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহও ওদের নেই। ওরা দু’ বেলা দু’ মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। বেদেরা শীতের মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের একেক এলাকায় ১ মাস করে ৫-৬ মাস থাকে। বর্ষা মৌসুমে ওদের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। সে কারণে জীবিকার উদ্দেশ্যে ওরা আবার চলে যায় উত্তর বঙ্গে। বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই ওরা নদীতে নৌকায় ভেসে কাটায়। জলে ভেসে চলা নৌকাই ওদের ঘর-বাড়ি। ওদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এ তিনই হয় নৌকায়। নদী ও নৌকা এ দুটিই ওদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। জলে বাস করে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে ওরা টিকে থাকে প্রতিনিয়ত। এ ভাবেই চলে ওদের জীবনযাপন।
পটুয়াখালীর গলাচিপা পৌরসভার ফেরিঘাট এলাকার রামনাবাদ নদী তীরে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের ডেরার কাছে গিয়ে দেখা ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদী তীরের বিভিন্ন স্থানে ২০-২৫ টি ডেরা আছে। প্রতিটি ডেরায় ৪-৫ জন লোক থাকে। নদী তীরের সৌন্দর্যকে যেন আরও বর্ধিত করেছে বেদে সম্প্রদায়ের সারিবদ্ধ এই ছোট ছোট ডেরা। সকালে নারীরা ডেরা থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বা উপকরণ পুরনো কাপড়ে গাট্টি বেঁধে মাথায় নিয়ে দল বেঁধে ছুটে চলেছে গ্রামের দিকে। কিছু দূর গিয়ে ২-৩ জন করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ওরা পৌঁছায়। সেখানে ওরা বাড়ির সামনের পথে হেঁটে হেঁটে মন মাতানো সেই ছন্দময় কথাগুলো সুরে সুরে বার বার বলে। এতে আকৃষ্ট হয়ে বাড়ির নানা বয়সের নারী-পুুরুষ ও ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি ও বিনোদন পাবার আশায় বাইদানীদেরকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে ওরা দাঁত ও বাত ব্যাথাসহ বিভিন্ন রোগীদেরকে তাবিজ, কবজ, ওষুধ, কড়ি দেয় এবং কখনো কখনো যাদু ও সাপ খেলা দেখায়।
বিনিময়ে চাল অথবা টাকা নিয়ে মনের আনন্দে ওরা আবার সন্ধ্যার আগেই ডেরায় ফিরে আসে। এদিকে খুব ভোরে পুরুষরা পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে ডেরা থেকে বেড়িয়ে পড়ে। ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে আছে স্টীলের বাট কিংবা গাছের ডাল ও রাবারের সাহায্যে তৈরি একটি ছটকা এবং পর্যাপ্ত মারবেল গুলি। মূলত এই ছটকা ও মারবেল গুলি দিয়েই ওরা পাখি শিকার করে থাকে। নিখুঁত নিশানার কারনেই ওরা পাখি শিকারে পটু। পাখি শিকারের উপযুক্ত স্থান হলো গ্রামের বন-বাদাড়। তাই পাখি শিকারে যে যার মতো করে সেই স্থানগুলোর দিকেই ছুটছে। সন্ধ্যার আগেই ওরা প্রত্যেকেই কম-বেশি পাখি শিকার করে ডেরায় ফিরে আসে। ওরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অবশিষ্ট পাখি বাজারে বিক্রি করে। তবে সকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে ওরা এখন লুকিয়ে পাখি শিকার করে। সাহসী পুরুষরা জঙ্গলে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় বিষধর সাপ ধরে ডেরায় নিয়ে আসে। সাপগুলোর বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে কিছু সাপ তাদের বশে এনে নিজেদের ব্যবসার কাজে রেখে বাকী সাপ বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে দেয়। সাপ ধরে বিক্রি করাও ওরা কমিয়ে দিয়েছে সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার কারণে।
পুরুষদের কেউ কেউ ডেরার কাছে বড়শি দিয়ে নদীতে মাছ ধরে। ওরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকি মাছ বাজারে বিক্রি করে। পাশাপাশি রান্নার কাজও করে থাকে ওরা। এছাড়া ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও ওদের। আবার সময় করে ওরা নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে ওদের পেশাগত বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। যাযাবর জীবনযাপন ও খেটে খেতে অভ্যস্ত বেদে সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা। একতাবদ্ধ হয়ে থাকা ওদের জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য। বেদে সমাজে সরদারের আদেশ-নিষেধ পালন করাই যেন ওদের ধর্ম। সরদারের অনুমতিক্রমে ছেলে-মেয়েদের বিয়েশাদি ওদের নিজেদের মধ্যেই হয়ে থকে। ওরা বাইরের মানুষদের সাথে কম মিশে। বেশির ভাগ সময়েই ওরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে। বেদেরা খুব সাহসী। একদিকে ওরা খুব আবেগপ্রবণ।
আবার কখনো কখনো ওরা হিংস্র রুপ ধারন করে। বাইরের নানা বয়সের মানুষের কাছে ওরা কৌতুহল প্রিয় হয়ে থাকে। জনশ্রুতি আছে, বেদেরা ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের দক্ষিণ-চব্বিশ পরগনা জেলার বদরপুর এলাকা ও আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার কামাক্ষ্যা এলাকার আদিবাসী। ওদের অধিকাংশই মুসলমান ও অল্প সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে। তবে হাজার বছর ধরে এ দেশে বসবাস করায় ওরা বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে। বেদে সরদার ইমামুল হোসেন সাংবাদিক মো. নাসির উদ্দিন প্যাদাকে বলেন, ‘আমাদের সমাজের সব পুরুষ লোক ও মেয়ে লোক পরিশ্রম করে আয় করতে পারে। আমরা জঙ্গল থেকে বড় বড় সাপ ধরি। সাপ ধরতে কৌশল লাগে, আবার বুকে সাহসও লাগে। সাপ ধরতে গিয়ে আমাদের অনেকে সাপের কামড়ে মারাও গেছে। আমরা সাপ খেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দেই। নৌকার চেয়ে এখানে গাড়িতে আসা সহজ। তাই নৌকা এলাকায় রেখে এসেছি। নৌকায় আমাদের জন্ম। আবার এই নৌকাতেই আমাদের মিত্যু। জীবনের জন্যে নদীর জলে নৌকায় ভেসে এ ঘাট থেকে ও ঘাটে যাই। এইতো আমাদের জীবন।’