বুকভরা আশা আর মনে শঙ্কা নিয়ে পেঁয়াজ চাষে মহাব্যস্ত পাবনার চাষিরা। কন্দ পেঁয়াজ (মুঁড়ি বা মূলকাটা) চাষ করে কম লাভবান হওয়ায় তারা চারা পেঁয়াজ নিয়ে এখন আশা নিরাশার দোলাচলে। এরপরও থেমে নেই তারা। পাবনার আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার সরকার জানান, এবার (কন্দ ও চারা পেঁয়াজ মিলিয়ে) ৫২ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সাঁথিয়া উপজেলায় এ বছর ১৭ হাজার ১৫০ হেক্টর আর সুজানগর উপজেলায় ২০ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাবনার এ দুই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়।
প্রশান্ত কুমার সরকার আরও জানান, গত বছর পাবনায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাত হাজার হেক্টর বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়। গত দুই বছর পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা। এবার পেঁয়াজ চাষে আরও বেশি ঝুঁকেছেন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান তিনি। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ।
পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলায় উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসাবে দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক-পঞ্চমাংশ উৎপাদন হয় পাবনার এ দুই উপজেলায়। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দুই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করেন। একটি কন্দ (মূলকাটা বা মুড়ি) অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের চাষ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বরে। মূলকাটা পদ্ধতিতে চাষ করা নতুন পেঁয়াজ জানুয়ারিতে বাজারে পাওয়া যায়। হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ ওঠে মার্চের মাঝামাঝি। সরেজমিনে সাঁথিয়া ও সুজানগর উপেজলার বিল গ্যারকাপাড়, বিল গাজনা পাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি, ইসলামপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ পেঁয়াজের মাঠে। বাড়ির নারীরাও পুরুষ সদস্যদের সহায়তা করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশুকে বড়দের সঙ্গে পেঁয়াজ লাগাতে দেখা গেছে। দেশের অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়ার বনগ্রামে দেখা যায়, প্রতি মণ কন্দ পেঁয়াজ ৯০০-১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
হাটে পেঁয়াজের আড়তদার ইব্রাহিম হোসেন বলেন, মাস চারেক আগে প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম ছিল তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা। এখন বাজারে ‘মন্দা হাওয়া’ লেগেছে। তিনি আরও বলেন, তিন মাসের মধ্যে নতুন হালি পেঁয়াজ হাটে উঠতে শুরু করবে। তখন আরও দাম কমার আশঙ্কা রয়েছে। পেঁয়াজের দাম এভাবে নেমে গেলে কৃষকের লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠবে না। সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আরশেদ খান, কানু খান, বামনডাঙ্গা গ্রামের জসিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই বীজ কেনা ও চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া নিতে হয়। জমি চাষ, সেচ, সার, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তাদের বিঘাপ্রতি বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা লিজমানি জমির মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরও বেশি।
এছাড়া অনেক ছোট-বড় চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন। সাঁথিয়ার বিল গ্যারকা পাড়ের চাষি আবুল বাশার মোল্লা জানান, পেঁয়াজের দাম বাড়লে জমির বার্ষিক লিজ মানিও বাড়ে। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যারকা বিল পাড়ের জমিতে বাৎসরিক লিজমানি এ বছর প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে উৎপাদন খরচ বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা। তারা জানান, এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০- ৫০ মণ। সে হিসাবে ৬০০-৭০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলে চাষির উৎপাদন খরচও ওঠে না। চাষিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ কেউ হিসাব করেন না। হিসাব করেন শুধু কত টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে! বছরের পর বছর ধরে পেঁয়াজের দাম কম থাকবে, এ ধারণাটা চাষিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। তারা বলেন, দেশে সব কিছুর দাম বাড়ছে, জনগণের আয় বাড়ছে। তাই মসলাজাতীয় ফসল পেঁয়াজের দামও প্রতি বছর বাড়লে চাষিরাও লাভবান হতে পারবেন।
বাংলাদেশ ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি আলহাজ শাহজাহান আলী বাদশা জানান, চাষিরা বাপ- দাদার আমল থেকে চাষ করে আসা পেঁয়াজের জাতই চাষ করে আসছেন। ফলে বিঘাপ্রতি ফলন একই রকম হারে রয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়েছে, পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে। বিঘাপ্রতি ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য অন্যান্য ফসলের মতো পেঁয়াজের উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাত সম্প্রসারণ করা দরকার। পাবনার দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়। বাধাইকারকরা বেশি দাম ধরতে পারে।
পেঁয়াজ চাষে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও সাধারণ চাষিরা সে সুবিধাও পাচ্ছেন না। অনেকেই চড়া সুদে মহাজনী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষি বিপণন অধিফতরের পাবনা জেলা মার্কেটিং অফিসার হুমায়ুন কবীর জানান, চাষি ভালো দাম পেলে সেটাকে নেতিবাচকভাবে না নিয়ে ইতিবাচক দিকটিও ভাবতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে চাষিদেরও তো লাভবান হতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পাবনার উপ-পরিচালক আদুল কাদের জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে। সেগুলো দীর্ঘমেয়াদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। চাষি পর্যায়ে পৌঁছতে সঙ্গত কারণেই সময় লেগে যায়। তিনি জানান, বিগত কয়েক বছর ধরেই চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। এবারও তারা নায্যমূল্য পাবেন বলে তারা আশাবাদী।