পাবনা শহর থেকে আট কিঃমিঃ দূরে পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম ধোপাঘাটা। পাবনা- ঢাকা মহাসড়ক থেকে আরও তিন কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পাড়ি দিলে মৃত নূরুজ্জামান নূরু খানের বাড়ি। তিনি গত বছরের ২২ শে মে করোনা উপসর্গে মারা যাওয়ার পর তার গোসল-জানাজা, দাফন হচ্ছিল না। তার মৃতদেহ বিছানায় পড়েছিল কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা। বাড়ির আশপাশের শ শ লোক জড়ো হলেও তারা বাড়ির ভেতরে আসেননি। প্রশাসনের লোকজন অনুরোধ করলেও সেদিন গ্রামের কেউ কাছে যাননি। তার দাফনের কাপড় কেউ এনে দেননি।তবে খবর পেয়ে পানি গরম করে গোসল করিয়েছিলেন দুই মহৎপ্রাণ যুবক দেওয়ান মাহবুব ও শিশির ইসলাম। ঠিক একইভাবে পাবনার সুজানগরের পৌর সদরে ইদ্রিস আলী মিঞা (৬০) নামের এক বৃদ্ধ করোনা উপসর্গ নিয়ে গতবছরের ৯ জুন ভোরে মারা যান। করোনা সংক্রমণের ভয়ে ওই বাড়ির লোকজন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন কেউই তার গোসল করাতে আসেননি। যুবক দেওয়ান মাহবুব ও শিশির ইসলাম খবর পেয়ে তার দাফন, জানাজা ও দাফনের কাজে এগিয়ে আসেন। এরকম উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে। সেই মহৎপ্রাণ দু’যুবকের একজন দেওয়ান মাহবুবুল ইসলাম। তিনি পাবনা শহরে তার মৃত মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশন’। তিনি এর নির্বাহী পরিচালক এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দেওয়ান আজিজুল ইসলামের ছেলে। দেওয়ান মাহবুব এবার করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ চলাকালে আরেকটি মহতী উদ্যোগ দিয়েছেন। তিনি শহরের নৈশপ্রহরী, ছিন্নমূল, দুস্থ মানুষ এবং হাসপাতালে রোগীর অভিভাবকদের সাহরি সরবরাহ করছেন। গভীর রাতে সারা শহর যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন দেওয়ান মাহবুব তখন তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত থাকেন। এরপর চলে প্যাকেট তৈরির কাজ। দেওয়ান মাহবুব জানান, তিনি তার টিমসহ সাহরির শেষ সময়ের বেশ আগেই বের হন। কারণ খাবার প্যাকেট পেঁছে দিতেও বেশ সময় লাগে। তিনি জানান, প্রতিদিন তার সহযোগীদের সঙ্গে করে রান্না করেন এবং ২০০-৩০০ প্যাকেট (বাজেট সাপেক্ষে) তৈরি করেন। এরপর ঘুরে ঘুুরে সারা শহরে দুস্থ ও রোগীর অভিভাবকদের মধ্যে বিতরণ করেন এসব খাবার। এবার তার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এমন উদ্যোগ নেয়ার কারণ হিসেবে জানান, করোনার অব্যাহত বিস্তার ও লকডাউনের জন্য বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেরই পবিত্র রমজানে সাহরি খাবার মতো সামর্থ্য নেই। এছাড়া এবার রাতে খাবার হোটেল বন্ধ থাকায় পকেটে টাকা থাকলেও রোগীর অভিভাবকরা সাহরি কিনে খেতে পারছেন না। হাসপাতালে নিয়ম অনুযায়ী শুধু রোগীদের খাবার দেয়া হয়। তাই অনেকেই শুধু সাহরি খাবারের অভাবে রোজা রাখতে পারবেন না কিংবা না খেয়ে রোজা রাখতে বাধ্য হবেন। এসব চিন্তা থেকেই তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাহরি সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়া বলে তিনি জানান। দেওয়ান মাহবুব জানান, তাদের হিসাবমতে, শহরে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ প্যাকেট সাহরির খাবার দরকার। কিন্তু অর্থাভাবে তারা এতো দিতে পারছেন না। অনেক টাকার বাজেট লাগে। কিন্তু তাদের সীমিত সামর্থ্যে এর অর্ধেক মানুষকে সাহরি দেয়া সম্ভব হচ্ছে। নিজেদের ফাউন্ডেশনের অর্থ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের সহযোগিতায় এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন পাবনার এই যুবক। তার কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন তৌহিদরুর রহমান লিমন, রাইসুল ইসলাম লিমন, মাশফিক, জিসান ও আরেফিন সুনাম নামের আরও কয়েকজন। তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মাহবুব জানান, পঞ্চম রোজা থেকে তারা সাহরি বিতরণ করা শুরু করেছেন এবং তা অব্যাহত আছে। প্রতি রাতে দুটি অটোবাইক ভাড়া করে তার নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকরা হাসপাতালসহ শহরের নানাস্থানে অসহায় মানুষদের মাঝে এ খাবার বিতরণ করেন। খাবার গ্রহণকারীদের তালিকায় আছেন অসহায় রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনরা, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথে থাকা প্রহরী, রিকশাচালক, বিভিন্ন মার্কেটে থাকা নৈশপ্রহরী, রাস্তায় থাকা ভাসমান মানুষজন। সাহরির খাদ্য তালিকায় দেয়া হচ্ছে সাদাভাত, মুরগি, সবজি ও ডাল। আবার কোনোদিন সাদাভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। এছাড়া খিচুড়ি, ডিমভুনাও দেয়া হয়। করোনা সংকট এবং লকডাউনের এই দুঃসময়ে মধ্যরাতে অপ্রত্যাশিতভাবে খাবার পেয়ে আনন্দিত হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। শনিবার (২৪ এপ্রিল) মধ্যরাতে দেখা যায়, মানুষেরা সানন্দচিত্তে খাবার নিচ্ছেন। খাবারের অটোবাইকগুলো বেশ কিছু ব্যস্ততম এলাকায় খাবার পরিবেশন করে। এরমধ্যে রয়েছে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ইন্দ্রা মোড়, ট্রাফিক মোড়, হাসপাতাল গেট এবং কেন্দ্রীয় টার্মিনাল এলাকা। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়শেন (বিএমএ) পাবনা জেলা শাখার সেক্রেটারি ডা. আকসাদ আল-মাসুর আনন জানান, হাসপাতাল ঘুরে রোগী বা রোগীর স্বজনদের সাহরি বিতরণ করছেন পাবনারই একদল মহৎপ্রাণ যুবক। করোনা পরিস্থিতিতে বাসায় রান্না করা খাবার বক্সে এনে দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানেন। তিনি বলেন, এটা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ।