গৌরব ও ঐতিহ্যের ৬৮ তম বছরে পদার্পণ করল প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এ-ই বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়েছিল।যাত্রা লগ্ন থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যেমন দেশের জন্য রেখেছে অসামান্য অবদান।
তেমনি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে সৃষ্টি করেছে এক সাফল্য মন্ডিত ইতিহাস।যার সূচনা লগ্নে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি। অবিভক্ত বাংলায় রাজশাহী হয়ে উঠেছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজা-জমিদারদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী তথা এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা এ সময় ছিল খুবই কষ্টসাধ্য।
তারমধ্যে সরকারি এক নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। যার ফলে রাজশাহীবাসী পরে বীপাকে। উত্তরভঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দারুণভাবে উপলব্ধি করে তৎকালীন উত্তরবঙ্গীয় পন্ডিতবর্গ।
১৯১৭ সালে ব্রিটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম ই স্যাডলার নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণাকর্ম সম্প্রসারিত করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।সেখানে রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ ছিল। ১৯৫৩ সালে রাজশাহীর জনগণ কমিশনের ওই সুপারিশকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয়।
যেটা পরবর্তীতে আন্দোলনে মোড় নেয়। রাজশাহীর কৃতি সন্তান প্রখ্যাত আইনজীবী মৌলভি মাদার বখ্শ এবং রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরির যৌথ প্রচেষ্টায় অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাস হয়।
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরিকে উপাচার্য নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। গোড়ার দিকে ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়।পদ্মারতীরে ওলন্দাজদের নির্মিত ঐতিহাসিক বড়কুঠি নামে পরিচিত রেশম কুঠিকে করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভবন।
ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে থাকে রাজশাহী কলেজে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাড়িতে অস্থায়ীভাবে চলতে থাকে দাপ্তরিক কাজ। কিন্তু ১৯৬১ মতিহারের চিরসবুজ চত্বরের ৩০৩ দশমিক ৮০ হেক্টর জমির ওপর লে. কর্নেল জি সোয়ানি টমাস প্রণীত কলম্বো প্ল্যান অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থানান্তর করা হয়।
বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি অনুষদ। জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ সম্প্রতি ২টি অনুষদে বিভক্ত হয়েছে। মনোবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস।
ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা এবং ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব জিও সায়েন্সেস। ২৭.০৬.২০২০ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় আরও ২টি অনুষদ অনুমোদিত হয়েছে। কৃষি অনুষদ থেকে ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস এবং ফিশারীজ অনুষদ সৃষ্টি হয়েছে।
৬টি ইনস্টিটিউটসহ মোট ৫৮টি বিভাগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় উচ্চতর গবেষণা ও পরিচর্যার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি ইনস্টিটিউট শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে: ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (১৯৭৪), ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (১৯৮৯), ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স (২০০০), ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (২০০০), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (২০০০) এবং ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস (২০১৫)।
এছাড়াও ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স সেল এবং সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে মতিহারের সবুজ চত্বর ।
দেড় হাজার শিক্ষক তাঁদের মূল্যবান পাঠদানের মাধ্যমে গড়ে তুলছেন সমাজ বিনির্মানে কারিগর। সুদীর্ঘ এ-ই পথ চলায় তাদের অনেকেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করেছেন।তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম জাতির কাছে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
যেমন, ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, উপন্যাসিক সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, মাসুম রেজা ও জাতীয় ক্রিকেটার আল আমিন হোসেনদের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি । শুধু শিক্ষাঙ্গনের গন্ডিতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আবদ্ধ থাকে নি।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইতিহাসের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। ১৯৬২ সালের বিতর্কিত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনে, ৬৬ এর ছয়-দফা, ‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এ সময় পাকিস্তানি আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারান শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে চির ভাস্বর করে রেখেছেন বিখ্যাত তিন শহীদ অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আবদুল কাইউম এবং অন্যায়ের কাছে আপোষহীন জীবন্ত শহীদখ্যাত বীর মুক্তিযুদ্ধা অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস।
শুধু তাই নয় স্বাধীনতাসংগ্রামে বাঙলার মাটিতে লাল-সবুজের পতাকা চির ভাস্বর রাখতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ হয়েছেন আরো অনেক শিক্ষার্থী ও কর্মচারী। আজও তাদের জীবন্ত সাক্ষর বহন করে চলেছে চির সবুজ চত্বরেের স্থাপত্যগুলো। যেমন,শহীদ মিনার, শহীদ সংগ্রহশালার দুটি মুরাল ও মুক্ত মঞ্চ।
নিতুন কুণ্ডের সেই ঐতিহাসিক সাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্য। যেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করছে প্রতিনিয়ত সিনেট ভবনের দক্ষিণ চত্বরে দাড়িয়ে। প্রয়াত শিল্পী নিতুন কুণ্ডের তৈরি এই ভাস্কর্যের পাদদেশে আছে একটি মুক্ত মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমান স্মরনে “বিদ্যার্ঘ স্মারকসৌধটি নির্মিত হয়। যেটা শহীদ হবিবুর রহমান হল চত্বরে অবস্থিত|
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড.শামসুজ্জুহার স্মরনে নির্মিত হয় স্ফুলিঙ্গ ভাস্কর্যটি এবং বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। তাছাড়াও শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ, গবেষণার সুনাম, অভিনবত্ব ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের লক্ষ্যে রাজশাহীবিশ্ববিদ্যালয় আজ যথেষ্ট এগিয়ে।
সম্প্রতি স্কোপাস’র প্রকাশিত জরিপে গবেষণাকর্মসমূহ এবং গবেষণা সংশ্লিষ্ট পরিমিতির নিরিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ স্থান অর্জন করেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। দেশের অন্যতম সেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অত্যাধুনিক এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৫০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনাকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে এ মহাপরিকল্পনাসহ আরও বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যার মধ্যে সাত পুকুর গবেষণা প্রকল্প, গবেষণা জালিয়াতি রোধে প্ল্যাগারিজম প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয় আরকাইভস ও অনলাইনে তথ্য জমা রাখার জন্য ‘আরইউ ক্লাউড’, ব্র্যান্ডিং গিফট শপ, বিশ্ববিদ্যায়ের নিউজলেটার ‘বিদ্যাবার্তা’, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যচিত্র, সৌন্দর্য্য বর্ধণ, ওয়েবসাইট আধুনিকীকরণ, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নামকরণ।
এছাড়াও একটি ২০ তলা আবাসিক ভবন, ছেলেদের ও মেয়েদের একটি করে ১০ তলা আবাসিক হল নির্মান এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। যেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অত্যাধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিশ্বের দরবারে অক্ষত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ৬৭ বছর অতিক্রম করে আজ ৬৮ বছরে পা রাখল প্রাচ্যের ক্যামব্যিজ খ্যাত এ-ই বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সাক্ষী রাবি তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করেছে শিক্ষা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, খেলাধুলাসহ সর্বাঙ্গনে অসামান্য সফলতা অর্জন করে। আজ ৬৮ বছরে পদার্পণলগ্নে আমাদের প্রত্যাশা, এ-ই আধুনিক বিশ্বে আমাদের মেধা,শ্রম এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব দরবারে আরো বেশি গৌরবমণ্ডিত করে তোলবে এবং দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে আরো বেশি তৎপর হবে রাবি প্রশাসন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা।
সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত এ-ই বিশ্ববিদ্যালয়। এগিয়ে যাবে দেশ। আমাদের বিশ্বাস একদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হবে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে শীর্ষতম সেরা সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ-ই হোক আমাদের প্রত্যাশা।