
বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)-এর ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার “মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প”-এর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও প্রকল্পের কাজে ফাঁকি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এই অবৈধ অর্থ দিয়ে নিজ নামে, স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে, শ্যালক- শ্যালিকা, শ্বশুর-শাশুড়ি ও অন্যান্য আত্মীয়দের নামে ও ঢাকা সিটি ও ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় জমি, গাড়ি ও ফ্লাট ক্রয় এবং বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে হতদরিদ্রদের জন্য টুইন পিট ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়েছে। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ছাড়াই ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সরকার ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ স্যানিটেশন স্বাস্থ্যবিধি’শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তখন খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। ২০২১-এর জানুয়ারিতে শুরু করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ করতে বলা হয়। সারা দেশের আট বিভাগের ৩০ জেলার ৯৮টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় গ্রামের বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ (বড় স্কিম স্থাপন), পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ (ছোট স্কিম স্থাপন), স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট স্থাপন, কমিউনিটি ক্লিনিকে নতুন স্যানিটেশন এবং হাইজিন সুবিধা, হাত ধোয়ার স্টেশন, হতদরিদ্র পরিবারের জন্য পিট ল্যাট্রিন স্থাপন করার কথা।
কুমিল্লা ও পাবনা জেলায় সঠিকভাবে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হলেও অধিকাংশ জেলায় এ কাজে গলদ পাওয়া গেছে। জামালপুরে বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহের জন্য জলাশয় ভরাট করে পানির পাইপ টানা হয়। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে স্পেসিফিকেশন (শর্ত) অনুযায়ী ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়নি। মৌলভীবাজারের সদর উপজেলা ও রাজনগর উপজেলায় বিভিন্ন কাজে অনিয়ম দেখা গেছে। পানি সরবরাহের জন্য মাটির তিন ফুট নিচে পাইপলাইন স্থাপন না করে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মাটির ওপর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে (ছোট স্কিম) মাটির মাত্র তিন ইঞ্চি নিচে নিম্নমানের পাইপ বসানো হয়েছে, এর ওপর কোনো বালি দেওয়া হয়নি। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে হাত ধোয়ার স্টেশন করা হলেও তা ব্যবহার হয় না। ইউনিয়ন পরিষদে যে পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হয়েছে, তা বন্ধ থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে অনেক দূরে ডোবায় পাবলিক টয়লেট করা হয়েছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে একটি হাত ধোয়ার স্টেশন করা হলেও কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে না দেওয়ায় তা ব্যবহার হচ্ছে না।
বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহের জন্য নকশা অনুযায়ী মাটির তিন ফুট নিচে পাইপ বসানোর কথা থাকলেও ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল ও মুক্তাগাছা উপজেলায় মানা হয়নি এই শর্ত। ছয় ইঞ্চি নিচ দিয়ে নিম্নমানের পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। কোথাও মাটির ওপর দিয়ে, কোথাও মাটির তিন ইঞ্চি নিচে পাইপ বসানো হয়েছে। পিট ল্যাট্রিনে খুবই নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বাড়ি থেকে অনেক দূরে ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। ত্রিশালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমি মাঠের পাশের পাবলিক টয়লেটের টাইলস ভেঙে গেছে। মুক্তাগাছা সরকারি পশুর হাটের পাবলিক টয়লেটের গুণগত মান খারাপ হয়েছে।
বরিশালের হিজলা ও আগৈলঝাড়া উপজেলায় বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহের ছোট স্কিমেও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাইপ দেওয়া হয়নি। মাটির মাত্র ৯ ইঞ্চি নিচে নিম্নমানের পাইপ বসানো হয়েছে। পানির এ সংযোগ পেতে কারও কারও টাকা খরচ হয়েছে। দুই পিন প্লাগ না দিয়ে সকেটে সরাসরি তার ঢুকিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। হিজলার মেঘনাঘাটের পাশে পাবলিক টয়লেটের র্যাম্প বেশি উঁচু করায় সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে পারেন না।
এ ছাড়া ৩০টি উপজেলার ১৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল ভবন থেকে অনেক দূরে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করায় সেগুলো ব্যবহার হয় না। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অধিকাংশ পাবলিক টয়লেটে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেই। ১৫ জেলার বাজার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও মসজিদে ২৭টি জনসমাগম স্থানে হাত ধোয়ার স্টেশন করা হলেও সেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফেনী, ময়মনসিংহ ও মৌলভীবাজার জেলায় পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে পানির বড় স্কিমের কাজ করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে এই সকল অনিয়মই করেছেন প্রকল্প পরিচালক তবিবুর। তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করে ত্রুটিপূর্ন মালামাল স্থাপন করার সুযোগ দিয়েছেন। এতে যেমন ঠিকাদারদের লাভ হয়েছে তেমনি পকেট ভরেছে তবিবুরের। এছাড়া, প্রকল্পের উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা যৌথভাবে দূর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ইতোমধ্যে আত্মসাৎ করেছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম সর্বনিম্ন দর আহ্বানকারীকেও ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার নজির আছে এই প্রকল্পে। এছাড়াও কাজ না করে বিল প্রদান, অবৈধ সুবিধা নিয়ে অগ্রীম বিল প্রদান করেছেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করে এইসকল সুযোগ দিয়েছেন।
ঘুষের টাকা নিয়ে কাজ না করার মত অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকায় অন্তত চারটি ফ্লাট আছে। হাউজ ৩৯, ফ্ল্যাট এ২, রোড ৪/এ, ধানমন্ডি, ঢাকাতে সে মাঝে মাঝে রাত্রিযাপন করে, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে ও গুলশানে ফ্ল্যাট রয়েছে তার। হোন্ডা সি আর ডি নম্বর- ঢাকা মেট্রো- ঘ ১২-৭৩৬৭। গাড়িটির দাম প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। গাড়িটি মহাখালী ডিএইচএস মোটরস থেকে কিনেছেন তিনি। গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে NAVANA DEL EVANTHE, বাড়ি-৬৮, রোড ১-এ, ধানমন্ডী আর/এ। মালিকের নামের জায়গায় দিদার ই আলম নামক এক ব্যক্তির নাম রয়েছে, তার ভোটার আইডি নম্বর- ১৯২২৮৫২৫২৮। এছাড়াও অন্তত দুইটি ব্যাক্তিগত গাড়ি আছে তার। এবিষয়ে মানব সম্পদ উন্নয়নে গ্রামীন পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প-এর প্রকল্প পরিচালক মো. তবিবুর রহমান তালুকদারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর দেননি।