
বিডি ২৪ অনলাইন নিউজ: ‘এ অফিস দুর্নীতিমুক্ত’-টঙ্গী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে ঝুলছে এমন সাইনবোর্ড। তবে বাস্তবতা উল্টো, রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। এখানে কর্মচারীর মুখ থেকে কথা বের করতেও দেখাতে হয় টাকার চেহারা! সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরের টেবিলে টাকা ফেললে যেভাবে চাইবেন, সবকিছু মিলবে সেভাবে। ওপর মহলের ছায়ায় সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দলিল লেখকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। ঘুষ ছাড়া মিলেনা সেবা, নড়েনা ফাইল। এমন চিত্র অতীতেও ছিলো, বর্তমানেও কোনো অংশে কম নেই।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এ অফিসে গেল দুর্গাপূজা সরকারি ছুটি দেওয়ার শেষ কর্মসপ্তাহে ৬ কোটি টাকার অধিক রাউন্ড ফিগার মূল্যের জমিতে ভেন্ডার সমিতির সিন্ডিকেট সদস্যদের সহায়তায় দানপত্র দলিল সই করাসহ লাখ লাখ টাকা ঘুষবাণিজ্যের মিশন ছিলো ওসমান গনি মন্ডলের, অথচ অনাকাঙ্ক্ষিতবশত সেই দলিলটি তখন সম্পাদনে বাধা হয়। জানা যায়, দলিলটি পেন্ডিং অবস্থায় আছে এবং শীগ্রই দানপত্র দলিলটি সম্পাদনের জন্য দেনদরবার চলছে। অভিযোগ রয়েছে, শত কোটি টাকার অঢেল সম্পদ, গাজীপুর শ্রীপুরে স্ত্রীর নামে জমি, সাব রেজিস্ট্রার ওসমান গনির অসদাচরণ, বাংলাদেশ রেজিষ্ট্রেশন সার্ভিস এসোসিয়েশনকে অবমাননা করে বর্তমান কমিটির নেতৃবৃন্দদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কটুক্তি কথা, ‘নির্ধারিত ফিসের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, মূল দলিলের নকল উত্তোলন করার জন্য সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে ২/৩ গুণ বেশি ফি আদায়, মূল দলিলে গ্রহীতার নাম পরিবর্তন করে দেয়াসহ নানা অপকর্মের মহোৎসবের কায়েম রাজত্ব করেছে ভেন্ডার সমিতির সিন্ডিকেট চক্র ও (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাব রেজিস্ট্রার। ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতারা বলছেন, ‘নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত টাকা না দিলে কাজ হয় না এই অফিসে। জমির দলিল আটকে রেখে চাপের মুখে ঘুষ দাবি সাব-রেজিস্ট্রার, অফিস সহকারী, নকলনবিশদের নিয়মিত আচরণে পরিণত হয়েছে।
টঙ্গী সাব রেজিস্ট্রি অফিসটি রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুরের মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস। টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা, পূবাইল ও গাছা থানা এলাকার সব জমিজমা ও স্থাপনার দলিল সম্পাদন এখানে হয়ে থাকে। নগরায়নের ছোঁয়া ও শিল্পাঞ্চলসহ এই চারটি মেট্রিপলিটন থানা এলাকায় জমিজমা অনেক বেশি হস্তান্তর হয়ে থাকে অথচ চলতি বছরে গত ১৬ জুলাই অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যান (এলপিআর) টঙ্গীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব রেজিষ্ট্রার আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনদিন পর পার্শ্ববর্তী কালিগঞ্জ উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার মো.হাফিজুর রহমানকে এ অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কাপাসিয়া সাব রেজিস্ট্রার ওসমান গনি মন্ডল’কে টঙ্গীর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এক রাঘববোয়ালের অবসর হলেও তারই প্রেতাত্মা একই পথ অনুসরণ করে চলছে অর্থাৎ (পূর্বের সিন্ডিকেট, সিন্ডিকেটের রোষানলে স্বয়ং সাব রেজিস্ট্রার তাল মেলাচ্ছে)। গাজীপুর ৫ টি উপজেলা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয় রয়েছে ৭ টি। তার মধ্যে টঙ্গী, সদর, সদর ২য় যুগ্ম- এই তিনটি কার্যালয় লোভনীয় পয়েন্ট। অনেকে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ নিয়ে এখানে বদলী হয়ে আসে। দলিল চাপের মুখে সপ্তাহে দু’দিনের পরিবর্তে তিনদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেও সপ্তাহের ৫ কার্যদিবসের ঘাটতি কোনো অংশেই কমাতে পারছে না, এদিকে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানের অনুমতিতে ২ দিন কাপাসিয়া দায়িত্ব পালন করছে। দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের দলিল বেলা ১১ টায় সাবমিট করলে বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার অবসান শেষে সিরিয়াল মেলে। এসব দুর্ভোগের কারণে জমির মালিকরা জমি বেচাকেনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। পাশাপাশি দলিল লেখকরাও বেকার হয়ে পড়ছেন। সাধারণের চোখে এত পরিশ্রম, চেষ্টা এগুলো দৃশ্যমান হলেও, পর্দার আড়ালে অনুসন্ধানে উঠে আসে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওসমান গনি মন্ডল ও দলিল কারসাজি সিন্ডিকেটের মুলহোতা ভেন্ডার সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম স্বপন ও সভাপতি জাহাঙ্গীরের আশকারায় ৬ কোটির অধিক মূল্যের একটি দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রি হয়। যার ফলে বিপুল পরিমান অর্থ সিন্ডিকেটসহ উক্ত কর্মকর্তা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও সেবাগ্রহীতাদের সাথে অসদাচরণসহ, বর্তমান ‘বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস এসোসিয়েশন’ কে নিয়ে উস্কানিমূলক কথাবার্তা প্রতিবেদক’কে বলেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিটিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গুলশানের একটি নির্দিষ্ট স্থানে সকলেই বদলি বাণিজ্য করে বেড়ায়, এই পকেট কমিটিতে ওসমান গনি মন্ডল’কে সাথে না রাখলে এই কমিটি হতো না’।
এছাড়াও ২০২২ সালে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর সাব রেজিষ্ট্রার অফিসে অনেক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত ছিলো একপর্যায়ে পাবনা বদলি হলে নতুন কর্মস্থলে যোগাযোগ না করেই অধিদপ্তরে কিছু অসাধু কর্মকর্তার আশীর্বাদে ১৭ দিনের ব্যবধানে গাজীপুর কাপাসিয়া বদলি হয়ে আসেন, যদিও কাপাসিয়া দীর্ঘদিন যাবত শূন্য পদে ছিলো। তবে এটিই ছিলো তার মাস্টারপ্ল্যান। আদালত ১ বছর পিআরএল অনুমতি পেয়ে তার টার্গেট ছিলো টঙ্গী রেজিস্ট্রি অফিস। গত জুলাই মাসে ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল’ অবসর হলে টঙ্গী অফিসে পরবর্তী সময়ে কালিগঞ্জের হাফিজুর রহমান কিছুদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের পরপরই সাব রেজিস্ট্রার ওসমান গনি মন্ডলকে টঙ্গীর দায়িত্ব দেওয়া হয় সপ্তাহে ৩ দিন। অথন সপ্তাহের এই ৩ দিনই দলিল বাণিজ্যের হাটবাজার চলে এই অফিসটিতে। নিবন্ধন পরিবারে অধিকাংশ কর্মকর্তাই ‘মিস্টার ৫% ওসমান’ নামে আখ্যা দিয়েছেন বিগত সময়ে। চাকরি জীবনে যখনই যেখানে কর্মরত ছিলেন, দাপটের সঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতো রাজখোকাদের আশীর্বাদে আজকের এই ওসমান গনি মন্ডল শত কোটি টাকার মালিক। অথচ গণমাধ্যমের কাছে উল্লেখ করেছে, পাবনা সদর বদলি হওয়ার পর স্ত্রীর চিকিৎসা জনিত কারনে ১৭টি প্রেসক্রিপশন অধিদপ্তরকে জমা দিয়ে, স্ত্রীর চিকিৎসার ফতোয়া দিয়ে গাজীপুর কাপাসিয়ায় শূন্য পদে দায়িত্বে এসেছে, তবে ঘটনার অন্তরালে রয়েছে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য।
টঙ্গী রেজিস্ট্রি অফিসে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ কেলেঙ্কারি। এর আগে ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ জুলাই পর্যন্ত সাব রেজিস্ট্রারের একই চেয়ারে রাজত্ব করেছিলো মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত আবু হেনা মোস্তফা কামাল, পূর্বের জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহারের আশীর্বাদপুষ্ট। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আবু হেনা মোস্তফা কামাল দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির যেমন অভিযোগ ছিলো, বর্তমানে ওসমান গনি মন্ডল দায়িত্বকালীন সময়ে একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
ওসমান গনি মন্ডলের বিপুল সম্পদের তালিকা-
১. উত্তরা ঠিকানা: সেক্টর-১২, রোড-১৬, বাসা-২৬
ফ্ল্যাট: ২টি
২. গাজীপুর শ্রীপুরে নিজ স্ত্রীর নামে কিনে রেখেছেন জমি/প্লট।
৩. ক্যান্টনমেন্ট (মৌজা: বাইলজুরি) ফ্ল্যাট: ২টি
৪. নিজ গ্রামে ডুপ্লেক্স বাড়ি ভুরুঙ্গামারি উপজেলার নিজ গ্রামে নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার অভ্যন্তরে আধুনিক সাজসজ্জা ও দামি আসবাবপত্রে সজ্জিত।
৫. ভুরুঙ্গামারি, মৌজা: মইদাম-জমি (৮৭৭ শতক)
টঙ্গী সাব রেজিস্ট্রার অফিসে ভেন্ডার সমিতির ৩ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্রান্ত অনুসন্ধানের সত্যতা:
এ অফিসে রাজনৈতিক বড় একটি অপশক্তি কাজ করছে। যা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেও নিষিদ্ধ সংগঠন সহ মূল দলের চেইন অব কমান্ডের নির্দেশনায় যেভাবে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো, ২৪ এর ৫ই আগস্টের পরও ঠিক একই ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শুধু প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই কার্যালয়ের সকল ধরনের অনিয়মের কারসাজিতে মূল ভূমিকায় রয়েছেন ৩ জন। তার মধ্যে অন্যতম – দলিল লেখক সমিতির (সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম – সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হোসেন বকুল), সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান স্বপন। এদের চোখের ইশারায় সাব রেজিস্ট্রারের নিত্যদিনের দলিল সম্পাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অফিস শেষে রেজিস্ট্রারের খাস কামরায় ভাগ বন্টন, রেকর্ড কিপারের নকল তল্লাশিতে অনিয়ম বাড়তি টাকা লেনদেন, নৈশ প্রহরী হান্নানের অসদাচরণ। এছাড়াও সমিতির নেতৃবৃন্দ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রকদের উচ্চবিলাশী জীবনযাপন, বিদেশগমন, ছেলেমেয়েদের দেশের নামিদামি স্কুল কলেজে পড়াশুনা ইত্যাদি। আয়ের উৎস সিন্ডিকেট ঘুষ বাণিজ্য।
এ সকল অনিয়ম প্রসঙ্গে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান’কে একাধিকার মুঠোফোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।