বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আমাদের প্রকৌশলী, উপকরণ সরবরাহকারী, শ্রমিক, ব্যবস্থাপক আর স্থানীয় ও বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরলস কর্মকাণ্ডের ফসল এ সেতু। বদ্বীপ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি পরিবর্তনশীল, নদীর গতিপথ অস্থির, নদীর তলদেশ অস্থিতিশীল। একটি জটিল ও দুরূহ পরীক্ষা তাঁরা সম্মিলিত উদ্যোগে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের অবদান পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর অবদান নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আগেই শুরু হয়ে গেছে। সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্মাণসামগ্রীর সরবরাহের একটি বড় অংশ আমাদের স্থানীয় উৎপাদক ও সরবরাহকারীরাই করেছেন। সেতুর জন্য ৭ দশমিক ৫ লাখ টন সিমেন্ট আর ২ দশমিক ২ লাখ টন ইস্পাত স্থানীয় প্রস্তুতকারকেরাই সরবরাহ করেছেন, যা শ্রম নিয়োজনের বাড়তি সুযোগ করেছে এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ—এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে আপাত দৃশ্যমান নয় কিন্তু ইতিবাচক আরেকটি দিক হলো, এ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অর্জিত মানবপুঁজি। এই বিশাল ও জটিল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বড় অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের যে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে, সে মানবসম্পদের মূল্যায়ন টাকায় পরিমাপ করা কঠিন। এ প্রযুক্তি-জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লব্ধ পুঁজি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ, যার ইতিবাচক ফল থেকে অর্থনীতি লাভবান হবে পরবর্তী বহু বছর ধরে।
এ সেতু নিয়ে যে প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে প্রাক্কলন করা হয়েছিল যে অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুণক ইতিবাচক প্রভাবে দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি সংযোজন হবে। রেল সংযোগের কারণে জিডিপিতে যুক্ত হবে আরও ১ দশমিক শূন্য শতাংশ। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত হওয়ার কারণে যানবাহন পারাপার বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থান হবে সাড়ে সাত লাখ মানুষের। সে অর্থে ৪৩০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপিতে ১০ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত যোগ হবে, যা গুণক আকারে বাড়বে। এ অবদান আসবে সেতু ও সড়কের সুবিধা নিয়ে যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হবে, সময় সাশ্রয়ী ও ব্যয়সাশ্রয়ী পরিবহন হবে, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে তার সুবাদে। টোল আদায়ের বাইরে এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে কর ও করবহির্ভূত সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদেই হবে দেশের অর্থনীতিতে এ সেতুর অবদান। এসব সম্ভাবনার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে এসব বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে সেতু থেকে সড়ক করিডর ও সড়ক করিডর থেকে অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তর অভিমুখী নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। ইতিমধ্যে সেতুকে ঘিরে অ্যাপ্রোচ রোডের দুধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান হচ্ছে। সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। শুধু স্থানীয় বাজারমুখী নয়, রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপও অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে গ্রহণ করছেন। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নতি হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পণ্য ও সেবার সহজ চলাচলের কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, রপ্তানিকারক, সেবা খাতকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণের নতুন নতুন সুযোগ ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ—এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু। যোগাযোগ সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ ও বাণিজ্য সংযোগ—এই ত্রিমুখী সংযোগের সার্থক সমন্বয় করতে সক্ষম হলে পদ্মা সেতু হবে অর্থনৈতিক করিডরের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
বিবিএসের হিসাবমতো, দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ১৩টির ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের অংশ বাংলাদেশের গড়ের চেয়ে বেশি; এসব অঞ্চল থেকে বিদেশি শ্রমবাজারে অংশগ্রহণও তুলনামূলকভাবে কম। সেতুকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসৃজন যেমন সৃষ্টি করতে পারবে, তেমনি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের অংশগ্রহণের বাড়তি সুযোগও সৃষ্টি করবে। এসব সুযোগ বাস্তবায়িত করতে হলে এ অঞ্চলে প্রযুক্তি বিস্তার ও প্রশিক্ষণের প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পদ্মা সেতুর এসব ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করতে হলে সমন্বিতভাবে বিনিয়োগ কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে। সময়মতো, সাশ্রয়ীভাবে ও সুশাসনের সঙ্গে এসব সমান্তরাল উদ্যোগের বাস্তবায়ন ইকোনমিক করিডরের ইতিবাচক অবদানে দেশকে সমৃদ্ধতর করবে। এর জন্য বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, ওয়ান-স্টপ অ্যাক্ট ২০১৮-এর আলোকে সিঙ্গেল-উইন্ডো সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশীয় বিনিয়োগ আহরণে উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রণোদনা কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হবে। বাণিজ্য সহজীকরণ, প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিক ও পেশাদার মানুষদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীশাসন, সেতুর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা বিধান হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে অর্থায়নের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এটাও নিশ্চিত করা জরুরি যে যানবাহন যেন পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া দ্রুতগতির মহাসড়ক পেরিয়ে ঢাকা নগরে প্রবেশের সময় বড় ধরনের যানজটে না পড়ে। যেসব যানবাহন অন্যত্র যাবে, তারাও যেন ঢাকা নগরকে পাশ কাটিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারে। এটা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনামাফিক ঢাকার অভ্যন্তরীণ চক্রাকার সড়ক ও পূর্বাঞ্চলীয় বাইপাসের নির্মাণকাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। পদ্মা সেতু থেকে প্রত্যাশিত আর্থিক ও অর্থনৈতিক রিটার্ন নিশ্চিত করতে হলে এসব উদ্যোগ দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। সমান্তরাল উদ্যোগগুলোর সার্থক বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত ইতিবাচক অর্জনসমূহকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১’-এ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের যে অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে সে অভীষ্ট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
- মোস্তাফিজুর রহমান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো






বরিশাল কর অফিসের রতন মোল্লার হাতে আলাদিনের চেরাগ,একই কর্মস্থলে ১০ বছর
বরিশালের ১৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা
এনসিপি ৩০০ আসনেই শক্তিশালী প্রার্থী দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে : সারজিস
মির্জা ফখরুল লড়বেন ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে
বগুড়া-৬ আসনে লড়বেন তারেক রহমান
খালেদা জিয়া নির্বাচন করবেন তিনটি আসন থেকে
বিএনপির শীর্ষ নেতারা কে কোথায় মনোনয়ন পেলেন
বরিশালে অপসাংবাদিকতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ ৩৫ সংগঠন