গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল। তবে এসব শাড়ি পরার সঙ্গে আজকের শাড়ি পরার খানিকটা পার্থক্য রয়েছে।
শাড়ি শব্দের উৎপত্তি কোথায়? যেহেতু এই বস্ত্রের ইতিহাস অতি দীর্ঘ, তাই শব্দটির জন্মবৃত্তান্তকে ঘিরে রয়েছে একাধিক মতবাদ। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত শব্দ ‘শাটী’ থেকে ‘শাড়ি’র উৎপত্তি হয়েছে। বহু ইতিহাসবিদ এই তত্ত্বকে মানতে নারাজ। তারা দাবি করেন, ‘শাটী’ নিজেই তো সংস্কৃতের মৌলিক সম্পদ নয়, তাহলে ‘শাড়ি’র উৎপত্তি-শব্দ হচ্ছে কেমন করে? আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই নাকি ‘শাটী’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল।
সমগ্র ভারত এবং পূর্ববঙ্গ জুড়ে চোখে পড়ে শাড়ির রকমফের। অঞ্চলভেদে যেমন পোশাকটির ধরণ বদলেছে, তেমনই পরার ধরনও। আবহাওয়ার ওপরেও নির্ভর করে পোষাকের বিভিন্নতা। গ্রামবাংলার শাড়ি এবং মধ্য, দক্ষিণ ভারতে শাড়ি পরার ধরণ পৃথক পৃথক। শাড়ি পরার ধরণ দেখে বলে দেয়া যায় মানুষটি দেশের কোনো প্রান্তের। তবে পুরাকালের মতো এখনও একটি ক্ষেত্রে মিল রয়ে গিয়েছে। প্রথম দর্শনে শাড়ি বলতে মনে হয় দীঘল কোনো বস্ত্র। যা সারা দেহের লজ্জা নিবারণে সমর্থ।
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হত ‘ধূতি’, আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’। নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরের ওপরের অংশ উন্মুক্তই থাকত। তবে কখনও কখনও উচ্চবংশের নারীরা পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিত।
রামচন্দ্র মজুমদারের কথায় এর সমর্থনও পাওয়া যায়- ‘তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার- এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরেছে। ওপরে জড়ানো থাকত আধনা বা আধখানা।’
 
মধ্যযুগের কবিদের কাছ থেকে শুধু শাড়ির কথাই জানা যায় না, শাড়ির রংয়ের কথাও জানা যায়। চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন— ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ।’
 
প্রথম মা হওয়া নারীকে উপহার হিসেবে দেয়া হত লাল শাড়ি। শাড়ি পরার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বিভাজন ছিল। ধনী নারীদের শাড়ি ছিল মলমলের মিহি কাপড়ের। আর গরিবের শাড়ি ছিল সাধারণ সুতি কাপড়ের; তাও আবার ছেঁড়া। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা সুইয়ে তালি দেয়া শাড়ি পরতে হত তাদের।
 
মুসলমানরা ভারতবর্ষে আগমনের ফলে এখানকার পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। তুর্কি-আফগান-মোগল সংস্কৃতির ধারা স্থানীয়রাও গ্রহণ করেছিল। পাগড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পায়জামার মতো পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শাড়ির গুরুত্ব কমে যায়নি। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে।

১৯ শতকের চল্লিশ দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। এমন কি গোড়ালি দেখানোটাও অসম্মানকর হিসেবে বিবেচিত হত। সেই সময় ভারতীয় গরমের মধ্যেও ইংরেজরা ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের পোশাক পরতে পিছ পা হননি। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে থাকা জমিদার ও স্থানীয় ধনীদের পোশাক-পরিচ্ছেদেও ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের স্টাইল যোগ হয়। এ সময়ে শাড়ির সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই রীতিতে শাড়ি পরাটা বাঙালি নারীর চিরায়ত এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। আর সেটা যে হুট করেই হয়েছিল তা কিন্তু নয়।
 
১৯১০ সাল বা বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে শাড়িগুলোতে খেয়াল করলে দেখা যাবে তাতে কোনো কুচি নেই। তারও আগে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরার চল তাদের মধ্যে দেখা যায় না। আদিবাসী নারীদের মাধ্যেও এই চল রয়েছে। আগেকার দিনে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজের চল ছিল না। ব্লাউজের আগমন অনেকটা পরে। ঠাকুর বাড়ির হাত ধরে। জানা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ইংরেজদের বিভিন্ন ক্লাব বা অনুষ্ঠানে যেতেন শুধু শাড়ি পরে। ইংরেজরা পছন্দ করলেন না এই পোশাক। উন্মুক্ত প্রায় বক্ষাংশে আপত্তি জানাল তারা। মনে করা হয় এরপরেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবী শাড়ির সঙ্গে শুরু করেছিলেন ব্লাউজ এবং অন্তর্বাস পরার চল। ফুলহাতা ব্লাউজ এবং কুচিছাড়া শাড়িই ছিল সেই সময় উঁচু সমাজের নারীদের প্রধান ফ্যাশন। বাঙালি সংস্কৃতি এবং নারী দেহে আবশ্যক পরিধেয় হিসেবে জায়গা করে নেয় ব্লাউজ।

 
উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকেই শাড়ি পরার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের হাওয়াটা যে আসি আসি করছে তার একটা সূত্রপাত কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। নারীরা যে ঊর্ধ্বাংশে কিছু পরে না, এজন্য বিরূপ মন্তব্য শুরু হয়ে গিয়েছিল সেসময়টা থেকেই। তখনও সেভাবে ব্লাউজ পরার চল হয়নি। অন্তত গ্রামে তো অবশ্যই। যেমনটা ‘আক্কেল গুড়ুম’য়ে রাজকুমার চন্দ্র ১৮৬৩-৬৪ সালে লিখেছেন, ‘দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেংটা’। এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ লিখেছেন, ‘আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরূপ কাপড় পরে, তাহা না পরিলেও হয়।’
মোগলদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। তার দেখানো পথ ধরেই হাঁটলেন মোগলরা। শুরু হল ভারতীয় নারীদের নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মোগল সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন। সেই ধারাবাহিকতায় শাড়িতেও মোগলাই আভিজাত্যের সংযোজন। তবে সেসময়ে অভিজাতদের মধ্যে শাড়ি ব্যাপকভাবে চল না হলেও শাড়িতে আভিজাত্যের উপস্থিতি থাকত পূর্ণমাত্রায়।
বৃহৎ ভূমণ্ডলের পাশাপাশি শাড়ির তারতম্য রয়েছে অঞ্চল ভেদেও। গ্রামবাংলায় হস্তশিল্প হিসেবে শাড়ি তৈরির কাজ চলে এখনও। অঞ্চলভেদে শাড়ির প্রচলন বা বুননের পিছনেও থাকে আঞ্চলিক ইতিহাস। শান্তিপুর হোক কিংবা রাজবলহাট, জায়গায় জায়গায় শাড়ির উৎপাদনের পেছনে রয়েছে কারণ এবং সময়ের ব্যবধান। তৎকালীন শাসকদের রুচির পরিচয় পাওয়া যেতে পারে এর থেকে। সময় যত গড়িয়েছে ততই এক জাতি বা গোষ্ঠীর সম্পদ মিশেছে অন্য জাতি, গোষ্ঠীর সঙ্গে। ফলে দুই পক্ষের মিলনে জন্ম হয়েছে নতুন ঘরানার।
শাড়ি এক সময় বাঙালি নারীদের পরিধেয় হলেও তা ক্রমে জনপ্রিয় হয়েছে অবাঙালিদের মধ্যেও। শাড়ির পাড় কিংবা আঁচলের কাজে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন নিজের মনের মতো ছবি। সে গ্রামের কোনো দৃশ্যও হতে পারে কিংবা আলপনার মতো করে কিছু ডিজাইন। শিল্পীদের কাছে এও এক ক্যানভাস বটে। নানারকম দামী পাথর ছাড়াও সোনা-রূপার সুতা দিয়ে শাড়িতে নকশার কাজ করা হত। মোগলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত জেনানা মহলে। মোগলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেয়া হত। আর সম্ভবত মোগল আমলে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ বা বক্ষ ঢাকার রীতি চালু হয়। তবে তা উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে ব্লাউজ পরার চলটা হয় ঠাকুর বাড়ির বউ এর পর থেকেই।
মোগলদের বাংলা জয়ের পর ‘জমিদার’ একটি বিশেষ পদবি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জমিদার মানেই বিশাল সম্পত্তির মালিক। স্বাভাবিকভাবেই সেসময়ে ধনী শ্রেণি হিসেবে ‘জমিদার’ গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাদের সময়েও শাড়ি পরা হত এক প্যাঁচে। ব্লাউজও এ সময়ে শাড়ির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আভির্ভূত হয়। তবে গ্রামবাংলার সাধারণ নারীরা কিন্তু সেই ধারা থেকে ছিলেন যোজন যোজন দূরে।
ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে শাড়ি পরার ধরন। ১৯২৮ সালে শিল্পী এম.ভি ধুরন্ধরের জলরংয়ে আঁকা ছবি। ফ্যানি পার্কস ১৮৫১ সালে তার বইয়ে লিখেছেন- ‘ধনী নারীরাও শাড়ি পরত। আর শীতের সময় ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি হিসেবে ব্যবহার করত চাদর।’ তবে তখনও পেটিকোট বা সায়ার প্রচলন হয়নি অন্তত সাধারণ ঘরের নারীদের জন্য তো অবশ্যই।