
টানা দ্বিতীয়বারের মতো রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) মেয়র হচ্ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রায় লাখ ভোটে হারিয়ে এই সিটির তৃতীয় নির্বাচনে তিনি বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার সঙ্গে একেবারেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেননি, ভোটের হিসাবে পেয়েছেন চতুর্থ অবস্থান। আওয়ামী লীগের এক ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বরং তার চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে হয়েছেন তৃতীয়। আর মোস্তফার এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত অস্থায়ী ঘোষণা কেন্দ্র থেকে রংপুর সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর আগে সারা দিন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোট নেয়া হয়।
২২৯ কেন্দ্রের সবগুলো থেকে পাওয়া ফলাফল বলছে, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে মোস্তফা পেয়েছেন এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। হাতপাখা প্রতীক নিয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. আমিরুজ্জামান পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে রংপুর সিটিতে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছিলেন মো. লতিফুর রহমান। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতি প্রতীক নিয়ে ৩৩ হাজার ৩৬৬ ভোট নিয়ে তিনি তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। আর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া নৌকা প্রতীক নিয়ে রয়েছেন চতুর্থ স্থানে। তিনি পেয়েছেন ২২ হাজার ২৩৯ ভোট।
জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত অস্থায়ী ঘোষণা কেন্দ্র থেকে রংপুর সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। ছবি: দৈনিক বাংলা
নির্বাচনে বাকি প্রার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আবু রায়হান ডাব প্রতীকে পেয়েছেন ১০ হাজার ৫৪৯ ভোট, জাকের পার্টির মো. খোরশেদ আলম গোলাপ ফুল প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ৮০৯ ভোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মো. শফিয়ার রহমান মশাল প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ১৩৮ ভোট, খেলাফত মজলিসের মো. তৌহিদুর রহমান মন্ডল দেওয়াল ঘড়ি নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৮৬৪ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মেহেদী হাসান হরিণ প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ৬৭৯ ভোট।
২০১২ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় রংপুর। সেবার প্রথম নির্বাচন হয় নির্দলীয়ভাবে। সেই নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন মোস্তফা। তবে সেবার আওয়ামী লীগ নেতা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও তারা দুজনই ছিলেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দলীয় প্রতীকের সেই নির্বাচনে ঝন্টুকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো রংপুরের নগরপিতার আসনে বসেন মোস্তফা। এবার তৃতীয় নির্বাচনেও তিনি জয়ের ধারা অব্যাহত রাখলেন।
ভোটের পরিবেশ
সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হওয়া ভোট শেষ হওয়ার কথা ছিল বিকেল সাড়ে ৪টায়। কিন্তু ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণে ধীরগতি হওয়ায় তা শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টার দিকে।
সকাল পৌনে ৯টায় রংপুর নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আলমনগর রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে যান মোস্তাফিজার রহমান। ৪ নম্বরে কক্ষের ইভিএম মেশিনে ত্রুটি দেখা দেয়ায় তিনি সময়মতো ভোট দিতে পারেননি। পরে প্রায় আধা ঘণ্টা পর তিনি ভোট দেন।
আর সকাল পৌনে ১০টায় রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া।
সকাল থেকেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ভোটাররা আসতে থাকেন কেন্দ্রে। নারী-পুরুষের সমান উপস্থিতি ছিল। ইভিএমে ভোট দেয়া নিয়ে আগ্রহ ছিল ভোটারদের। কিন্তু বাদ সাধে ইন্টারনেটের ধীরগতি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর ভোট দিতে পারেন অনেকে।
মূলত ইভিএম মেশিনে আঙুলের ছাপ না মেলা, ভোট দিতে সময় নেয়া, ইভিএম মেশিন ব্যবহারে ভোটারদের অনভ্যস্ততার জন্য ভোট গ্রহণে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।
সন্ধ্যার পরও বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটার
রংপুর সিটিতে ভোট গ্রহণের সময় ছিল বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের মধ্যে শত শত ভোটার উপস্থিত থাকায় সন্ধ্যার পরও ভোট নেয়া হয়।
২৪ হাজারী কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া ভোটার মফিজুর রহমান বলেন, ‘চার ঘণ্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ভোট দিই। সারাটা দিন ভোট দিতে শ্যাষ।’
২ নম্বর ওয়ার্ডের অভিরাম মনোহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রের ভোটার সজীব জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ভোট দেন তিনি। বিকেল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল ভালো
কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ভোট হয়েছে রংপুরে। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল স্ট্রাইকিং ফোর্স।
মোস্তফার অভিযোগ
মঙ্গলবার দুপুরে নিসবেতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘ইভিএমের ত্রুটির কারণে প্রথম দফায় ভোট দিতে পারিনি।’
তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট এস এম ইয়াসিরও বলেন, ইভিএম মেশিনে ত্রুটি দেখা গেছে। ভোটাররা ফিরে গেছেন। আঙুরের ছাপ না মেলায় অনেক ভোটার ভোট না দিয়েই বাড়ি ফিরেছেন।
কমিশনের বক্তব্য
রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে, সেটি হয়েছে। একই সঙ্গে ইভিএমে ত্রুটি নিয়ে জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার অভিযোগকে নিছক বিতর্ক উসকে দেয়ার প্রয়াস বলে মন্তব্য করছেন তিনি।
আব্দুল বাতেন বলেন, ‘তার অভিযোগ জানার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে ইভিএমের কোনো ত্রুটি ছিল না।’ তবে কিছু ভোটারের হাতের আঙুল পরিষ্কার না থাকায় আঙুলের ছাপ মিলছিল না বলে স্বীকার করে নেন তিনি।