প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স বিদ্যালয়। উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এলাকার অবহেলিত প্রতিবন্ধীদের জন্য সবুজ ঘেরা নিবৃত এক পল্লীতে গোতাশিয়া ইউনিয়নের চুলা গ্রামে ১১৩ শতাংশ জমির উপর রয়েছে ওই বিদ্যালয়ের অবস্থান।
মনোহরদী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা পরিচালিত ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দেখভাল করে আসছেন ইউসূফ মিয়া নামে একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। ওই গ্রামের সৈয়দ তোতা মিয়া, সৈয়দ মুকুল মিয়া, মোসা. রিনা বেগম, ফজরের নেছা, রজবের নেছা এবং আয়েশা বেগম প্রতিষ্ঠানটির জমিদাতা।
দীর্ঘ ১১ বছর ধরে অবহেলিত শিশুদের পাঠদান করে আসলেও এখনো পর্যন্ত এমপিওভূক্ত না হওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। চুলা গ্রামের ইউসূফ মিয়া নিজেই জন্ম সূত্রে আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) একজন মানুষ।
তার এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করেন। অবশেষে চুলা গ্রামের মৃত সৈয়দ তছর আলীর ছেলে সৈয়দ তোতা মিয়ার সাথে আলাপ করার পর বিদ্যালয়ের নামে জমি লিখে দিবেন বলে আশ্বাস দেন। এরপর ২০০৯ সালে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে স্থানীয় কয়েকজন প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন।
দিন দিন শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে স্থায়ীভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৩ সালে ‘মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স বিদ্যালয়’ নামে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য ১১৩ শতাংশ জমি লিখে দেন তোতা মিয়া ও অন্য দাতাগণ। ইউসুফ হাসান জানান, যেসব প্রতিবন্ধী আগে স্পষ্ট করে কথা বলেতে পারত না, লেখতে পারত না, বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা চিনত না।
এখন তারা অনেকটাই বলতে পারে, লেখতে পারে এবং বর্ণমালা চিনে। আগের চেয়ে এখন অনেকটাই সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব শিশু জন্মগতভাবেই অদ্ভুত অঙ্গ প্রতঙ্গ নিয়ে বেড়ে ওঠে, অস্বাভাবিক আচরণ করে, অন্যসবার সাথে মিশতে পারে না তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতেই এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
নরসিংদী জেলার কয়েকটি উপজেলাসহ অন্য জেলা থেকেও প্রতিবন্ধী শিশুরা এই বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলে বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৩০১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। পুরো বিদ্যালয় ভবনটি টিনশেড বিল্ডিং। ২০টি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে নিবন্ধনকৃত। যার নং ০৫৩৪। শিক্ষক রয়েছেন ৩০ জন এবং কর্মচারীর সংখ্যা ২৮জন। ছয়টি ট্রেডে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক মন্ডলি অত্যন্ত যত্নের সাথে শিক্ষা উপকরণের সহায়তায় পাঠদান করে থাকেন। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে আবাসিক সু-ব্যবস্থা। বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, খাবার ও গোসলখানার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা এবং ফিজিওথেরাপি ব্যবস্থাও রয়েছে এসব শিশুদের জন্য।
অটিজম শিশুদের জন্য খেলাধূলা এবং বিনোদনের আলাদা কক্ষ আছে। সকল স্থানে হুইল চেয়ারে চলাচল করার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে নৃত্য-সংগীত ও কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা। নাহিদা ইয়াসমিন নামে এক অভিভাবক বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক কষ্ট করে শিক্ষাদান করেন। তাই আমার সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে নিয়ে আসি। সে এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। তাকে এখন আর বোঝা মনে করি না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুন নাহার বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ২৪ ঘন্টা শিক্ষক-কর্মচারীরা সেবা দিয়ে থাকেন। তাদের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য মানসিকতা তৈরী করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের মধুর সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবছর আমাদের বিদ্যলয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা জেলা ভিত্তিক খেলাধূলা এবং অন্যান্য প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করে থাকে।
জমিদাতা মো. তোতা মিয়া জানান, আমি এবং আমার অন্যান্য শরিকরা পারস্পরিক আলোচনা করে এই প্রতিষ্ঠানের নামে দান করে দিয়েছি। এমন মহতী কাজে জমি দান করতে পেরে আমরা খুশি। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় নিজ এলাকাসহ অন্য জেলা এবং উপজেলা থেকেও প্রতিবন্ধী শিশুরা এখানে এসে শিক্ষার বিকাশ ঘটনোর চেষ্টা করছে। মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান ইউসূফ হাসান বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা অনেক কষ্টের।
তবুও শিক্ষকরা ওদের শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন তাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যালয়টি এমপিওভূক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাই।