ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে ফেসবুকের পুলিশ রিলেটেড বিভিন্ন গ্রুপ আর পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত টাইম লাইনে ছুটি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে পোস্ট বাড়ছে। গত ১৫ বছর ধরে দেখে আসছি এই জিনিস, এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রতি বছর পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স থেকে সার্কুলার আসে ১০-১৫ শতাংশের বেশী ছুটি ছাড়া যাবেনা, এর আগে নিজে ছুটি না গেলেও মাঝেমাঝে ৩০ শতাংশও ছুটি ছেড়েছি; ভেবেছি মাত্র তিনটা দিনই তো; চালিয়ে নিবো। এবারের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন, সরকারী নির্দেশনা ঈদে সকলকে যারা যার কর্মস্থলে থাকতে হবে। পুলিশ ছাড়া আর কতজন এই আদেশ মেনে নিজ কর্মস্থলে থাকবেন সেটা কি কেউ একটু খোজ নিবেন?
করোনার পর থেকে গত চার মাস যাবত অনেকে ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে সময় কাটাতে ফেসবুকে ১০ রকমের চ্যালেন্জ খেলেছেন, কেউ ১০ রঙের শাড়ী, পানজাবী, কেউ ১০ দেশ ভ্রমন, কেউ নিজের বানানো ১০ রকমের খাবার , কেউ নিজের দেখা সেরা ১০ টি মুভি পোস্ট করেছেন; আমাদের জন্য চ্যালেন্জটা ছিল বা আছে একেবারেই ভিন্ন। মানুষকে ঘরে রাখা, ঘর থেকে বা রাস্তায় পরে থাকা স্বজনবিহীন কাউকে হাসপাতালে নেয়া, কাউকে হাসপাতাল থেকে কবরে নেয়া, জানাজা পরানো ও কবরে রাখার কাজটাও করতে হয়েছে পুলিশকে, ইতিমধ্যেই হারিয়েছি আমাদের ৬১ জন সহকর্মীকে; তারা আর কোনদিন ঈদের আগে রিজার্ভ অফিসে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে তীর্থের কাকের মত আদেশের কপির, ছুটির সিসির জন্য অপেক্ষায় থাকবেন না।এই চরম বাস্তবতায় আমাদের সদস্যরা কি ধৈর্য্য নিয়ে মানিয়ে রেখেছে নিজেদের, যারা এখনও মানতে পারেনি তারা হয়তো নানা অজুহাত তৈরী করে ছুটি চাইবেন, কারও আবার একেবারেই প্রকৃত সমস্যা, বাবা, মা অসুস্থ; কেউ বছরে একবারই ছুটি যান একটু কোরবানী করার জন্য; কেউ অপেক্ষা করছেন সদ্যোজাত অথবা অনাগত সন্তানের প্রিয় মুখটা দেখবেন ছুটিতে গিয়ে। আজকেই একজন বয়স্ক ইনসপেকটর এসে আবদার করলেন ইউনিটে তো আরো অনেক ইনসপেকটর আছে স্যার, আমাকে একটু ছুটি ছাড়েন। তার মুখের দিকে তাকেনোর সাহস আমার হয়নি, অন্যদিকে তাকিয়ে বলি, সরকারী আদেশ , না মানার কোন সূযোগ নেই। তার ছাইবর্ন মুখ দেখা এড়াতে টেবিলে রাখা ফাইলে এলোমেলো কলম চালাই। সবেমাত্র যে ছেলে পুলিশে জয়েন করেছে, বাড়ীর বাইরে এটাই যার প্রথম ঈদ, সে হয়তো শখ করে মায়ের জন্য শাড়ী, বাবার জন্য পানজাবী কিনে ব্যারাকের খাটিয়ার পাশে ট্রাংকে রেখে নির্জন দুপুরে অথবা মাঝরাতে যখন সহকর্মীরা কেউ থাকেনা ট্রাংক খুলে দেখে, আর বুকে জড়িয়ে অনুভব করতে চায় এক বছর বা ছয় মাস আগে শেষ দেখা হওয়া বাবা মায়ের স্নেহের উত্তাপ, হয়তো চোখের কোনে একটু পানি সহসাই লুকিয়ে ফেলে সিনিয়র কেউ দেখে ঠাট্টা করবে এই ভয়ে।
আমি নিজে গত ১৫ বছরে দুই কি তিনবার ঈদের ছুটি নিয়েছি, পরিবার( কনা, সারিম) নিয়ে থাকি বলে ছুটি চাই ও নি, জুনিয়র যখন ছিলাম সিনিয়র ছুটিতে গিয়েছেন, আমি ইউনিট সামলিয়েছি; সিনিয়র যখন হলাম তখন জুনিয়রদের সূযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। গতবছর এখানে এসে কোরবানী ঈদ পেলাম, যোগদানের পর প্রথম ঈদ, ছুটি চাইবো কোন মুখে? এবার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই,ঐদিন আমারই এক সহকর্মী বলছিলেন ,স্যার পরিবারসহ থাকেন তাই ছুটি যান না। আমি তাকে কিভাবে বলি, আমারও ইচ্ছা করে ঢাকায় আমার নিকটাত্মীয় অথবা প্রতিবেশীর সাথে একটু কোরবানীর মাংস শেয়ার করতে, আশেপাশের গরীবদের পাশে একটু দাড়াতে, ঈদের বিকালটা প্রিয় বন্ধুদের সাথে হুল্লোড় করে কাটাতে।
আচ্ছা , গতকাল রংপুর মেট্রোর যে বয়স্ক কনস্টবলের বিধিভঙ্গ শিরোনামে মাস্ক না পরার ছবি নিয়ে আমার সহকর্মীরা সারাদিন ফেসবুকে ঝড় তুললেন তিনি সবশেষ কবে ছুটি গিয়েছিলেন তা কেউ বলেতে পারে? রাস্তায় যারা পুলিশকে একটু ডান বাম করতে দেখলেই মোবাইল তাক করে লাইভ শুরু করেন তারা কেউ কি কোনদিন জানতে চেয়েছেন, টানা ৮ ঘন্টা কখনও ১২ ঘন্টা রোদে পুড়ে ,বৃস্টিতে ভিজে ডিউটি করার পরও তিনি এখনও কিভাবে সুস্থ আছেন? অনেকেই জানলেও সকলে কি জানেন, বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসায় বা প্রতিরোধে আইজিপি স্যারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল রাতারাতি কিভাবে বিশেষ হাসপাতালে পরিনত হল? কেন এখন তা এদেশের অন্যতম সেরা কোভিড চিকিৎসাগার? সকলেই কি জানেন অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার রেডি রাখার কথা, কেউ কি জানেন প্রতিটি পুলিশ ইউনিটে ইউনিট কমান্ডাররা তাদের সদস্যদের সুরক্ষায় প্রতিদিন কি করছেন? কতজন লোক জানেন একজন পুলিশ সদস্য এক ঈদে ছুটি পেলে পরের ঈদসহ পরের বছরের ঈদও ইউনিটেই কাটাতে হয়? কয়জন জানেন প্রতিটি ঈদের দিন কত হাজার পুলিশ সদস্য দুপুরের খাবারটা ইউনিটের বড়খানায় শরীক হয়ে, রাতে কোনমতে খাওয়া শেষ করে অন্ধকার ব্যারাকে চোখবুজে ঝিম মেরে থাকেন? কতজন জানেন পুলিশের একজন সদস্য সবশেষ কবে তার আদরের ধনকে কোলে নিয়ে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে?
কোরবানী ঈদ আসলে আমার খুব ছোটবেলার একটা কাহিনী আবছা মনে পড়ে।আমরা তখন খুলনায়, আমার বয়স ৪ কি ৫।আব্বু কোন এক অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলেন, এদিক ঈদ পরের দিন সকালে, আব্বু আসবেন কিনা এখনও ঠিক নেই, তখন না ছিল টিএন্ড টি না মোবাইল, জানারও উপায় নেই।আবছা মনে পরে আব্বু এসেছিলেন একেবারে মাঝরাতে, আমরা তখন গভীর ঘুমে, সকালে বিছানার পাশে আব্বুকে আবিস্কার করি, সাথে একজোড়া লাল জুতা আমার জন্য।আমি এখনও মাঝে মাঝে ভাবি এটা কি সত্যই ঘটেছিল?এত ছোটবেলার কথা আমার কিভাবে মনে আছে, নাকি এটা আমার মস্তিস্কের কোন কল্পনা?
দেশের দুই লক্ষ পুলিশ সদস্যর অর্ধেকের বেশীর পরিবারের ছেলেমেয়েরা এবারও বাবা/ মা বিহীন ঈদ করবে। যারা কথায় কথায় পুলিশের দোষ খুজে বেড়ান তাদের বলবো এই করোনকালীন সময়ে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করতে না পারলে না করুন , দয়া করে মিথ্যা অপবাদ দিবেন না।
কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার Mohibul Islam Khan স্যারের ফেইসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া