রাজারবাগ ২৫শে মার্চ পুলিশের আত্মত্যাগ ও ১৫ই আগষ্টের ট্রাজেডি
ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি বাহিনী।
কে এএসআই ছিদ্দিকুর রহমান আর ডিএসপি অফিসার নুরুল ইসলাম খান?? প্রজন্মের জানা জরুরী।
বাংলাদেশ পুলিশ ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগে পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস সবারই অজানা। সবার জানা থাকলেও নেই কোন চর্চা নেই কোন স্মীকৃতি। পাকিস্তানী বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট সেই কালো রাতে অসম থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে অসীম সাহসিকতার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বীর পুলিশ সদস্যরা। একরাতেই আটশতাধিক পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। রাজারবাগে পুলিশের অবিশ্বাস্য প্রতিরোধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে পুলিশ সদস্যদের আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম। তাই গোটা পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। কারণ বাঙালি পুলিশ সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। তাইতো মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যেখানেই পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেখানেই তারা পুলিশ থানা দখলে নিয়েছে।
পরিস্থিতি বুঝেই বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রায় সব থানার অস্ত্রাগারের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন এবং নিজেরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রত্যেক জেলায় একই ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশের ডিআইজি, এসপি পদমর্যাদার অনেক অফিসার শহীদ হয়েছেন। কারণ পাকিস্তানি হায়েনাদের আক্রোশে বড় টার্গেট ছিলো বাঙালি পুলিশ।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল পুলিশের কেউই বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাননি। এমনকি বীরউত্তম খেতাবও কপালে জোটেনি। চার দশক পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান ছিল উপেক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১১ সালে পুলিশকে দেয়া হয় স্বাধীনতা পদক। পুলিশের বীর শহীদ কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার পর পুলিশকে জনগণের পুলিশ হতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই কথা রেখেছিল পুলিশ। ১৯৭৫ সালে পিজিআর গঠনের আগ পর্যন্ত ঢাকা জেলা পুলিশ বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলো। বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছে নিতে পুলিশ সবসময় সজাগ ছিল। প্রতিটি সরকারী সফরে পুলিশ সদস্যরাই বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার এবং প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করতেন।
দিনকাল ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ভোররাতে পিজিআর সদস্যদের অস্ত্র হাতে থাকার পরও আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করেছিল। কারণ তাদের বন্দুকে কোন গুলি ছিল না। ১৪ আগস্ট গভীর রাতে পিজিআরের সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ার্দার ঘাতকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পিজিআরের সব গুলি নিজের জিম্মায় নিয়ে নেয় বলে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু পুলিশের গুলি নেয়ার সুযোগ ঘাতকেরা পায়নি। তাই ভোরে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর আক্রান্ত হলে পুলিশ গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তার খেসারত হিসেবে ঘাতক সেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন পুলিশের এ এস আই ছিদ্দিকুর রহমান। গুলিবিদ্ধ হন পুলিশের ডিএসপি অফিসার নুরুল ইসলাম খান। সব পুলিশ সদস্যকে বন্দী করে অস্ত্র কেড়ে নেয় ঘাতকেরা। কিন্তু কোন পুলিশ সদস্যের গুলিতে রক্তাক্ত হয়নি বঙ্গবন্ধুর বুক।
ইতিহাসে কিভাবে উপেক্ষিত পুলিশ?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদদের তালিকার মধ্যে কর্নেল জামিলের ছবি দেয়া হয়। তাই সবাই মরহুম জামিল সাহেবের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানার সুযোগ পান। কিন্তু শহীদ এ এস আই ছিদ্দিকুরের নাম ক’জন জানেন? গুলিবিদ্ধ পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম খানের খবর ক’জন রাখে? মানুষ জানে না। কারণ তারা পুলিশ আর পুলিশের পরবর্তী প্রজন্ম সাহস করে বিষয়টিকে সামনে আনেননি। অথবা কেউ সে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়নি।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। কিন্তু ১৯৯৭ সালে ফ্রিডম পার্টির সদস্যরা গাজীপুরে তার মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান এবং আদালতে সাক্ষ্য দেন। তাঁর বড় ছেলে এরশাদের সময় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ভিপি ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির রোষানলে পড়েন। আরেক সন্তান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাহিদ খান বর্তমানে বিজিবির রংপুর রিজিওয়ন কমান্ডার। বিভিন্ন সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিজিআরের দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার করা হয়েছে।
৮৮ বছর বয়সী নুরুল ইসলাম খান এখন আমেরিকায় থাকেন। গত ডিসেম্বর মাসে তিনি দেশে এসেছিলেন। তখন তাকে খুঁজে বের করেন সিনিয়র এ এস পি সুদীপ্ত সরকার। মেধাবী এই অফিসার মনেপ্রাণে একজন দক্ষ গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা এবং সংগঠক হিসেবে তাঁর সৃজনশীলতা সম্পর্কে আগে থেকেই সূখ্যাতি ছিলো। তিনি সহ এই গবেষক এএসআই ছিদ্দিকুরের ছোট ছেলেকে খুজে বের করেন মীরপুর এলাকা থেকে।
নুরুল ইসলাম খান বলেছিলেন, তাঁর পাশেই ছিলেন এএসআই ছিদ্দিকুর রহমান। আচমকা একটা গুলি বুকে লাগার পর তিনি লুটিয়ে পড়েন। আর একটা গুলি এসে লাগে নুরুল ইসলাম খানের পায়ে। তিনি কাতরাতে থাকেন। পরে তাকে বন্দী করা হয়।
এএসআই ছিদ্দিকুরের পরিবার ঃ
স্বামী মারা যাওয়ার পর কোনো পেনশন দেয়া হয়নি এ এস আই ছিদ্দিকুরের পরিবারকে। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে অর্থাভাবে দিন কেটেছে ছিদ্দিকুরের স্ত্রী-সন্তানদের। ১৯৯২ সালে মা মারা যাওয়ার পর মাহাবুব এবং মাহফুজকে কঠিন জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। এখন দুইভাই বেকার। তাদের চাকুরী হওয়াটা প্রয়োজন।
ইতিহাস বলে, পুলিশ কখনই দেশ মাতৃকা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের সাথে বেইমানি করেনি। তাই ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির মত পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস বরাবরই ট্রাডেজি হয়ে আছে!