হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার পাটি শিল্প এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। অতীতে গ্রামের বাড়িতে অতিথিরা এলে প্রথমেই বসতে দেওয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। বর্তমানে হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম অনুষাঙ্গিক শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশিই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে। বেশ আগে দেখা যেত মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাটিকরদের নান্দনিক কারুকার্য। এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু বাপ দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই এই শিল্পটিতে অনেকেই রয়েছে। বর্তমানে উপজেলার ১১২ টি পরিবার পাটি শিল্পকে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আকড়ে ধরে রয়েছে। গৃহবধুদের হাতের ছোঁয়ায় নানা নকশায় উপজেলার ধর্মঘর, চৌমুহনী, শাহজিবাজার, শাহজাহানপুর, পানিহাতা, শ্রীধরপুর সহ ইত্যাদি গ্রামে তৈরি করা হয় শীতল পাটি। পাটি বড় চট, ছোট চট প্রভৃতি। রপ্তানি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও সৌখিন ব্যবসায়ী, বেড়াতে আসা অতিথিদের মাধ্যমে শীতলপাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেকে আবার নকশা করা শীতলপাটি দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখেন বসার ঘরের শোভা বাড়াতে। পাটি তৈরি শিল্পীরা নিজেদের স্বপ্নের পাশাপাশি গ্রামের অন্য নারীদের পাটি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাঘ-ফাল্গুন হচ্ছে পাটি বুনার উত্তম সময়। আর বৈশাখে সেই পাটির চাহিদা থাকে ব্যাপক। বছরে ২-৩বার সিলেট থেকে পাটির কাঁচামাল বর্ষজীবী উদ্ভিদ ‘মোতরা’ বা ‘পাইত্রা’ আসে। গ্রাম থেকে ১পোজা পাইত্রা/মোতরা ৫০-১০০টাকা আর সেই পাইত্রা/মোতরা হাট থেকে ৩০০-৩৫০ টাকায় কেনা হয়। ১পোজা পাইত্রা/মোতরা দিয়ে ১টি পাটি হয়। ওই পাটিটি ৫০০-৫৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। পাটির সাইজ অনুযায়ী বুননি মজুরী হয়ে থাকে। ৩হাত বাই ৪হাত ৯০টাকা, সাড়ে ৩বাই সাড়ে ৪ হাত ১২০টাকা ও ৪হাত বাই ৫হাত ১৪০টাকা। মান অনুযায়ী প্রতিটি পাটি বুনতে ২-৬ দিন লেগে যায়। উন্নত মানের পাটিকে ডালার বলা হয়। এটি বুনতে ৯-১০দিন লেগে যায়। ১টি পাটিতে বুননি খরচ হয় ৬০০ টাকা। পাইকারি বাজারে এর মূল্য ২৫০০-৩০০০টাকা। এজেলার পাটি বিক্রির অন্যতম বাজার মাধবপুর, নোয়াপাড়া, মনতলা, অলিপুর সহ বিভিন্ন হাট বাজারে। এ হাটে ঢাকা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ, মাধবদী, ভৈরব ও নরসিংদী থেকে পাইকাররা পাটি কিনতে আসে। এছাড়া স্থানীয়ভাবেও বাজারে বিক্রি করা হয়। মাধবপুর উপজেলার পানিহাতা গ্রামের পাটিকর মোঃ মাসুক মিয়া জানান, আমি ছোট থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমার ১ছেলে ও ২মেয়ে নিয়ে খুব একটা ভাল নেই। কারন জানতে চাইলে সে বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষের আমলে পাটির যে পরিমান চাহিদা ছিল তা আর সে রকম নেই বললেই চলে। সে সময় পাটির চাহিদা ছিল ব্যাপক এবং আমরা পাটি বিক্র করে অনেক টাকা উর্পাজন করেছি। এতে আমাদের সংসার খুব ভালবাবে চলতো। কিন্তু বর্তমানে পাটির চাহিদা না থাকায় আমার মতো অনেক পাটিকরের পরিবার কষ্টে জীবন যাপন করছে। এই ব্যাপারে দুর্গাপুর গ্রামের সুরেন্দ্র সরকার বলেন, আমরা ৪ভাই বাকি ৩ ভাই এ কাজে জড়িত। আমাদের বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমাদের সংসার এ দিয়ে কোনভাবে চলছে। গ্রামের বিয়েতে পাটির খুব চাহিদা রয়েছে। বাড়িতে এসেই তারা নিয়ে যায়। সরকার আমাদের সহযোগিতা করলে আমার মতো অনেক পরিবার এ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ নারী রয়েছে যারা পাটি বিক্রি করে সংসারের বাড়তি খরচের যোগান দেন। তারা নিজেদের পাশাপাশি এলাকার বেকার অন্য নারীদেরও স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখান। পাটিশিল্পের বিকাশে বড় সমস্যা একটি হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। শীতলপাটি তৈরির জন্য পাটি। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন হাছান জানান, আমি এ বিষয়ে পাটি শিল্পকে বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে আসছি। এখন মোরতার চাহিদা কম থাকায় পাটি শিল্পরা এখন এ শিল্প থেকে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।