আমাদের দেশের রাবার শিল্প ধীরে ধীরে হলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে রাবার শিল্প এরই মধ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশের রাবার শিল্প মালিকরা এখন সমন্বিত রাবার চাষের (বনজ, ফলজ, পশু পালন, পর্যটন) দিকে ঝুঁকছেন। দেশে উৎপাদিত উন্নত মানের রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
রাবার এমন একটি মূল্যবান অর্থকরী সম্পদ যার বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার রযেছে। রাবার গাছের কষ (ল্যাটেক্স) থেকে রাবার উৎপন্ন হয়। রাবার শিল্প/চাষ মূলত বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশদের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম রাবার চাষ শুরু হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার চাষ হচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে মাধবপুর উপজেলার শাহজিবাজার, সাতছড়ি সহ বিস্তৃর্ণ এলাকা। বাংলাদেশ রাবার চাষে নবীন হলেও এর ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ সহায়ক ও আর্থসামাজিক প্রয়োজনে রাবার চাষের গুরুত্ব অপরীসিম।
দেশে রাবার চাষের মাধ্যমে দ্রæত বনায়ন, বনায়নের মাধ্যমে বিস্তৃর্ণ এলাকার ভূমিক্ষয় রোধ, বিপুল কর্মসংস্থান, বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ের ব্যবস্থাসহ প্রভূত কল্যাণ সাধন হবে। এ প্রেক্ষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তি তুলে ধরব। ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মাধবপুর উপজেলার শাহজিবাজার এলাকায় রাবার বাগান দেখতে গিয়ে সহকারী বন সংরক্ষক কর্মকর্তা মোঃ মারুফ হোসেন বলেন, জরুরী কর্মসূচির মাধ্যমে ৮ বছর রাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।’ বাংলাদেশের রাবার চাষকে লাভজনক করা, জনসাধারণের অংশীদারিত্বের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, রাবার চাষিদের সহযোগিতা প্রদানের জন্য ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রাবার বোর্ড প্রতিষ্ঠিত করে। জাতির জনকের সে নির্দেশনা প্রতিপালন করার জন্য রাবার বোর্ড প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশেষজ্ঞের অভিমত, বাংলাদেশ এর মাটি ও জলবায়ু রাবার চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রাবার উৎপাদন মূলত কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। ট্যাপিং এলাকা, গাছের ফলন, ট্যাপিং এর জন্য কৃষকদের উদ্যোগ ইত্যাদি। রাবার চাষের সবচেয়ে গুরুত্ব¡¡পূর্ণ দিক হলো, রাবার গাছ পরিবেশবান্ধব। রাবার গাছ অন্যান্য সাধারণ গাছের চাইতে তিনগুণ বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এটি একটি যৌক্তিকভিত্তি যার মাধ্যমে বৈশ্বিক কার্বন ট্রেডিং এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ফান্ড থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। পামওয়েল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপরে যে বিরূপ প্রভাবের প্রতিফলন ঘটছে, বাংলাদেশের রাবার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওই সব বিরূপ প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে ক্ষতিকারক কার্বনের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। রাবার গাছ অনুর্বর পতিত জমিতে জন্মায়। এছাড়া পাহাড়ি জমিতে রাবার চাষ ভালো হয়। রাবার চাষের উন্নয়ন হলে রাবার বাগানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। প্রত্যন্ত অ লের পাহাড়ি, বাঙালি নারীরা কাজে নিয়োজিত হতে পাবে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হবে ও নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে। দেশীয় কাঁচা রাবার যখন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হবে, হাজার হাজার শিল্পপণ্য উৎপাদনে অনেকে কর্মসংস্থান হবে। রাবারভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সম্ভব। শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠানে নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ২৫ একরের রাবার বাগানে ১০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়। রাবার চাষের অথনৈতিক অবদান পরিবেশের ওপরে ইতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অতীতে রাবার চাষের ওপরে যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল, তাতে ব্যাপক জনগোষ্ঠী জড়িত হয়, তবে গত এক দশক ধরে এটি নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়ে পড়ায় ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লেও রাবার বোর্ড গঠিত হওয়ায় পুনরায় তাদের মধ্যে নতুন উদ্যমে কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাবার চাষ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক অবদান রাখা সম্ভব। সরকারি জমি লিজগ্রহীতাদের একটা বিরাট গ্রুপ রয়েছে যারা অনেকটা হতাশায় ভুগছেন। তাদের আবার অনুপ্রাণিত করে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রসার ও একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সহায়তা করা সম্ভব হবে। শত শত একর খালি পাহাড়ি জমি ও অনন্য পতিত জমি রাবার চাষের আওতাভুক্ত করে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে সবুজায়ণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় অবদান রাখা যাবে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা। বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে রাবার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা এবং রাবারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার। দারুণ সম্ভাবনাময় রাবার চাষ খাতকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপে যখন অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন বিপর্যস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত তেমন প্রেক্ষাপটে শ্রমঘন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব রাবার চাষকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ রাবার গার্ডেন ওনার্স এসোয়িশেন যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। রাবার শিল্পের উন্নয়নে রাবার গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। রাবার শিল্পে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে এবং এর উন্নয়নের ব্যাপারে অভিজ্ঞ লোকের অভাব থাকায় বিদেশ থেকে রাবার বিশেষজ্ঞ আনার প্রয়োজন রয়েছে। রাবার চাষের ব্যাপারে রাবার চাষিরা সব সময় আর্থিক সঙ্কটে ভূগেন। তারা মূলধন সমস্যার কারণে রাবার বাগান এর উন্নয়ন এবং মানসম্মত রাবার উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে। রাবার বাগান মালিকদের জন্য সরকার যে ঋণের ব্যবস্থা রেখেছিল তাও এখন বন্ধ রয়েছে। রাবার বাগান মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে প্রতি বাগানে ২৫ একর জায়গায় রাবার চাষ করা হচ্ছে। সেখানে এর পরিধি বৃদ্ধি করে ১০০ একর করতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশের যেসব স্থানে এখানও পর্যন্ত রাবার চাষ করা হয়নি, সেসব স্থানে রাবার বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। রাবার প্রসেসিং করার জন্য পৃথক পৃথক উন্নত প্রসেসিং প্ল্যান্ট সরকারি উদ্যোগে স্থাপন করতে হবে। এতে করে রাবারের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং মানসম্মত রাবার পাওয়া যাবে। রাবার গাছকে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরির মাধ্যমে শতশত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। রাবার শিল্পের সঙ্গে রাবার গাছের কাঠও দেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। এতে করে এই সেক্টরে আগামী ১০ বছরে প্রায় ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। রাবার চাষ আর্থিকভাবে লাভজনক করার জন্য রাবার বাগানের চারপার্শ্বে বনজ, ফলজ এবং বাগানের ভেতরে মৎস্য চাষ, হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরুর খামার গড়ে তোলা সম্ভব।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে বাংলাদেশে বর্তমান লক্ষাধিক একর জমিতে শ্রমঘন, পরিবেশবান্ধব, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী রাবার চাষ হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দরপতন, অবাধ আমদানি আর দেশীয় বাজারে রাবার বিক্রিতে অস্বাভাবিক কর, আরোপ ইত্যাদি কারণে বর্তমানে এই খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অপরদিকে রাবার চাষ ও রাবার শিল্পের উপর নির্ভরশীল চাষি, শ্রমিক, কর্মচারি, রাবার বাগান মালিক সবাই তাদের আয়ের সুযোগ হারিয়ে পথে বসবে। জরুরীভাবে এই সম্ভাবনাময় শ্রমঘন, পরিবেশবন্ধব, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী খাতটিকে সুরক্ষার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে দারুণ সম্ভাবনাময় পরিবেশবান্ধব রাবার চাষ খাতটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি সংশ্লিষ্ট মহলের সুদৃষ্টি প্রদান এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।