অভিমানে লুকিয়ে থাকে সুপ্ত ভালোবাসা। তবে অভিমান যখন রাগ-ক্ষোভে রূপ নেয়, তখন ভালোবাসা নামক স্বর্গীয় চেতনা হারিয়ে যায়। এমনি এক ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পলাশবাড়ী মন্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জহর উদ্দিন ওরফে বাচ্চু মিয়ার (৬৫) জীবনে। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে ২৭টি বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন তিনি। হাজারো কষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ করে যশোরের অভয়নগরে কাটিয়েছেন সময়টা।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে কুড়িগ্রামের সদরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নে আগমনী গ্রামে জাহেদা বেগমকে (৫০) বিয়ে করেন কৃষক বাচ্চু মিয়া। বিয়ের পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা ছিল না। ৬ মাসের শিশু সন্তান জাহিদুল ইসলামকে রেখে নিরুদ্দেশ হন বাচ্চু। প্রায় ৩ বছর পর ফেরতও আসেন। এরপর আবারও তুচ্ছ ঘটনায় স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে ১৯৯৪ সালে একেবারই নিরুদ্দেশ হন। অনেক খোঁজাখুজির পরেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার। দীর্ঘ ২৭টি বছর পর আকস্মিকভাবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিজ জন্মস্থানে ফিরে আসেন জহির উদ্দিন। তাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে পরিবার ও প্রতিবেশীরা।
জহির উদ্দিন ওরফে বাচ্চু মিয়া সিটি নিউজ ঢাকাকে জানান, স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়েন তিনি। বাসে করে চলে যান যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের গোবিন্দুপর গ্রামে। সেখানকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলে মিশে কাটিয়েছেন জীবনের এই দীর্ঘ সময়। কেউ তার ঠিকানা না জানলেও তাকে বেশ ভালোবাসতেন। সবাই তাকে বাচ্চু ভাই বলে ডাকতেন। সেখানেই তিনি কিছু দিন ফেরারি জীবন কাটান।
তিনি আরও জানান, এরপর গোবিন্দপুরের মৃত. মকন্দ মল্লিকের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। সেখানে বেশ কয়েক বছর কাটে তার। পরে আশ্রয় হয় সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের দোতলায় এক কক্ষে। এখানেই তার কেটে যায় ২০টি বছর। তিনি চাকরি না করলেও দিনমজুর হিসাবে পরিষদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন।
বাচ্চু মিয়া জানান, জীবিকার জন্য সাবেক চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক একটি ভ্যান গাড়ি কিনে দেন। এর পাশাপাশি সনতান ধর্মালম্বীদের সৎকার, বিয়েসহ যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ছিল তার পদচারণ। আচার-আচরণে তিনি পরিষদের চেয়ারম্যান, সচিব, মেম্বারসহ স্থানীয়দের সবারই কাছে আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
তিনি বলেন, “২৭ বছর পরে বাড়ি এসে দেখি আমার ৩ ভাই বেঁচে নেই। নেই এলাকাবাসীর সেই পরিচিত মুখগুলো। জীবন থেকে এতগুলো বছর নিরুদ্দেশ থেকে বড় ভুল করেছি। আমি আর কোথাও যাব না।”
জহর উদ্দিনের স্ত্রী জাহেদা বেগম বলেন, ভিক্ষা করে একমাত্র সন্তানকে বড় করছি। আর আশায় ছিলাম ছোঁয়ার বাপ ফিরে আসবে। ছোঁয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য কোথাও বিয়েও করিনি। মানুষটার রাগ খুব, আর বুদ্ধি-সুদ্ধি কম। এত দিন পরে ফিরে আসায় খুশি হইছি।
জহির উদ্দিন ওরফে বাচ্চু মিয়ার নাতি মুন ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ২৭ বছর পরে দাদু ফিরে এসেছেন। আমরা খুবই খুশি। দাদুকে কোথাও যেতে দেব না।
পলাশবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রুবেল সাইদুর রহমান বলেন, জহর উদ্দিনের খোঁজ না থাকায় আমরা গ্রামবাসী ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন। দীর্ঘ ২৭ বছর পর তিনি ফেরত আসায় প্রতিবেশী ও তার পরিবারের লোকজন সবাই খুব খুশি হয়েছে।