ভোটের সময়ে জনপ্রতিনিধিদের মুখের মধ্যে দেখা যায় কথার ফুলঝুরি। যার প্রতিশ্রুতি-আশ্বাস যত, তার জেতার সম্ভাবনাও যেন ততোই তৈরি হয়। আবেগী বাঙালি কোনো কিছু না ভেবেই বেশি প্রতিশ্রুতি ও মিষ্টি কথা বলা প্রার্থীকেই নিজের ভোট দিয়ে দেন। ভোট দেয়ার আগে একবারও চিন্তা করেন না; তিনি যাকে ভোট দিলেন তার দেয়া প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা!
বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের চাল চুরি ও আত্মসাতের কারণে বেশ কয়েক জনপ্রতিনিধি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, কেউ কেউ জেলও খেটেছেন। এ বছর আবার তাদের মধ্যে অনেকে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছে। যে জনপ্রতিনিধি জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যসামগ্রী চুরি করল সে কীভাবে আবারও নির্বাচিত হয়। জনগণই বা কেন তাকে ভোট দেয়?
নির্বাচনের সময়ে প্রার্থীরা এমনও প্রতিশ্রুতি দেয়; যা ১০ বার নির্বাচিত হয়েও করা সম্ভব নয়। প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো অনেকটা এমন হয়: আপনারা শুধু নির্বাচিত করবেন, তারপর যা বিপদ-আপদ বা যেকোনো কিছু হলেই নিজ দায়িত্ব সমাধান করব, কেউ না খেয়ে থাকবে না ইত্যাদি। এসব কারণে জনগণের কাছে তারা ফটকাবাজ বা প্রতারক হিসেবে অবিহিত হয়।
অনেক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরেই সালিশ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে, যা গ্রামাঞ্চলে বিনা পুঁজির লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। গ্রাম্য সালিশ চক্রে এলাকার জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা প্রভাব বিস্তার করে। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন মিলে সালিশ কার্যক্রমের আয়োজন করেন। অবৈধ অর্থ লেনদেনের ফলে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন কথিত বিচারকরা। যাদের অনেকেরই ছিল না সামাজিক কোনো ভিত্তি। কিন্তু বর্তমানে গায়ের জোরে, ক্ষমতার প্রভাবে তারাই সেজেছেন সমাজের কর্তা। বর্তমান সময়ের গ্রাম্য রাজনীতির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। আবার অনেককে গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এলাকার গণ্যমান্য প্রবীণরাও। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই উল্টো বিপদে পড়তে হয়, নিরীহ মানুষ শিকার হন ভোগান্তির। জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জনগণের আস্থা হারানোর এটি অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন সময়ই দেখা যায় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক ভিজিডিসহ বিভিন্ন ভাতার কার্ড বাণিজ্যের কথা। এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় প্রতিটি কার্ডের বিপরীত। এটিও জনপ্রতিনিধিদের আস্থা হারানোর কারণ। কেননা অতি দরিদ্রদের যে কার্ড সেটির জন্যও তারা জড়িয়ে পড়েন আর্থিক লেনদেনে।
অনেক সময় দেখা যায়, জনপ্রতিনিধিরা সরকারিভাবে বিভিন্ন বরাদ্দের আওতায় কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দকৃত সার ও বীজ সঠিকভাবে বিতরণ করেন না। আত্মীয় এবং দলীয় নেতাকর্মী এক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য পান। যার ফলে জনগণ বঞ্চিত হয়। আবার অনেক জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের পকেটভর্তি করেন। যার ফলে জনগণের বিভিন্ন বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সদস্যদের তোয়াক্কা না করে চেয়ারম্যান ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা, কাবিটা, টিআর, প্রকল্পের তালিকা বণ্টনসহ নানা ধরনের প্রকল্পের কাজ একাই করেন। পরিষদের উন্নয়নকাজে বরাদ্দ টাকাও চেয়ারম্যান সঠিকভাবে বণ্টন করেন না। এক্ষেত্রে ইউপি সদস্যরা বঞ্চিত হন। ইউপি সদস্যদের কিছু করার না থাকলেও তারাও জনগণের কাছে প্রতারক হিসেবে পরিচিত পান। এলজিএসপি, মসজিদ, মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের মতো করে ব্যবহার এবং কুক্ষিগত করে রাখার গুরুত্বর অভিযোগও পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে; যা জনপ্রতিনিধিদের আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ।