রবিবার ১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   রবিবার ১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ



আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয় গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কাহিনী
প্রকাশ: ৯ অক্টোবর, ২০২৫, ৩:৫১ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয় গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কাহিনী

বিডি ২৪ নিউজ রিপোর্ট:   বাংলাদেশের সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত রয়েছে দেশের বৃহৎ সরকারি ভবন, হাসপাতাল, আদালত ভবন, জেলখানা, সড়ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম। কিন্তু বহু বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঠিকাদার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকার অভিযোগে সমালোচিত হয়ে আসছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা—যাদের একজন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম।
সাবেক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও জাতীয় সংসদের চিরপ্রতাপশালী রাজনীতিক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয় হিসেবে পরিচিত এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে রয়েছে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। ঘুষ, কমিশন, ঠিকাদার সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশাসনিক প্রভাব ব্যবহার করে তিনি কীভাবে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন—এই প্রতিবেদন সেই অন্ধকার চিত্র উন্মোচন করার চেষ্টা করেছে।
কর্মজীবনের সূচনা থেকেই বিতর্ক : ড. মঈনুল ইসলামের কর্মজীবনের সূচনা থেকেই তার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে বিতর্ক ছিল। ১৫তম ব্যাচের সহকারী প্রকৌশলীরা যখন ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর চাকরিতে যোগ দেন, তখন তিনি যোগ দেন প্রায় ৯ মাস পর, ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট। শুরু থেকেই প্রশাসনিক নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে চলা এবং রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করার প্রবণতা তার ক্যারিয়ারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সবচেয়ে অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই দীর্ঘ ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন তিনি কর্মস্থল থেকে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা চাকরি হারাতেন স্থায়ীভাবে। বাস্তবেও তাই হয়েছিল—তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, পরে তিনি মন্ত্রণালয়ে আপিলের মাধ্যমে পুনর্বহাল হন। এ ঘটনা কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সরাসরি ইঙ্গিত বহন করে। অভিযোগ রয়েছে যে, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয় হওয়ার সুবাদে তিনি এই অস্বাভাবিক সুবিধা পান।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ ও ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’: গণপূর্ত অধিদপ্তরে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি মাত্র তিনটি বড় প্রকল্প থেকেই শত কোটি টাকার বেশি সম্পদ গড়ে তোলেন। কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি গণপূর্তের ভেতরে “মিস্টার টেন পার্সেন্ট” নামে পরিচিত ছিলেন। কারণ প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই তিনি বিপুল নগদ অর্থ, একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, এবং বিদেশে ব্যাংক হিসাব তৈরি করেন। দুদক ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তার সম্পদের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া এবং দুবাইয়ে তিনি বিনিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি বেতনের সঙ্গে তার বৈধ আয় মিলিয়ে এই বিপুল সম্পদ অর্জনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ : বাংলাদেশের সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো বিতর্কিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম। ২০১৯ সালে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পর শামীমের সম্পদ সাম্রাজ্যের খবর প্রকাশ্যে আসে। তদন্তে উঠে আসে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে তার গভীর যোগসাজশ ছিল। ড. মঈনুল ইসলামকে জি কে শামীম সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার কাছ থেকেও মঈনুল ইসলামের দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে। ঠিকাদার সিন্ডিকেট কীভাবে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, প্রকল্প ভাগাভাগি ও কমিশন বণ্টনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, তার সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মঈনুল। একটি মামলায় ঠিকাদার আসিফ, শাহাদাতসহ ১১ জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ৩১ কোটি টাকারও বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। মামলার আসামিরা সবাই ড. মঈনুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে জানা গেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি কেবল এককভাবে নয়, বরং একটি সুসংগঠিত চক্রের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুদকের অনুসন্ধান : ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আমলে নেয়। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর দুদক তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে। পরবর্তীতে তাকে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। সেসময় তার সম্পদ বিবরণী নেওয়া হয় এবং তদন্তকারীরা নথি যাচাই করে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন। এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ—এর আগে প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদক প্রায়ই ধীরগতির নীতি অনুসরণ করত। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও গণমাধ্যম-জনগণের চাপের কারণে এই মামলায় দুদক সক্রিয় ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগের অনিয়ম : ড. মঈনুল ইসলামের দুর্নীতির পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগেও অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট। এখানে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন অমিত কুমার বিশ্বাস। একজন স্থানীয় ঠিকাদার মাহবুব মোল্লা জেলা প্রশাসনের কাছে অমিত কুমারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনিয়ম করা হয়েছে, পিপিআর ২০০৮ এর নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে, এবং নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা পাইয়ে দিতে পেশিশক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। খুলনা শিশু হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিভিন্ন থানা ভবন নির্মাণ প্রকল্পে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ‘ভুতুড়ে’ মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সিন্ডিকেটভিত্তিক দুর্নীতি : এইসব তথ্য প্রমাণ করে, দুর্নীতি কেবল এককভাবে কোনো কর্মকর্তার সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি সুসংগঠিত চক্র, যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (যেমন ড. মঈনুল ইসলাম), মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা (যেমন অমিত কুমার), এবং প্রভাবশালী ঠিকাদাররা (যেমন জি কে শামীম) সবাই মিলে একটি “মাফিয়া সিন্ডিকেট” তৈরি করেছে।
এই সিন্ডিকেটের কাজ হলো টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিযোগিতা ঠেকাতে পেশিশক্তি ব্যবহার, নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের চুক্তি পাইয়ে দেওয়া, প্রকল্পের খরচ ফাঁপিয়ে দেখানো, ভুতুড়ে মেরামতের নামে সরকারি অর্থ লোপাট, কমিশন ভাগাভাগি করে বিদেশে অর্থ পাচার।
ফলে সরকারি প্রকল্পের মান নিম্নমুখী হচ্ছে, জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে এবং রাষ্ট্রের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বিপুলভাবে।
জনগণের আস্থা হ্রাস : সরকারি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো—জনগণের কল্যাণে অবকাঠামো উন্নয়ন। কিন্তু দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের মান কমছে, কাজ বিলম্বিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট হচ্ছে।
জনগণের করের টাকায় পরিচালিত এই প্রকল্পগুলো যখন একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়, তখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতি আস্থা ভেঙে যায়। অনেক ঠিকাদার সৎভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সাহস পান না। এমনকি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও সিন্ডিকেটের বাইরে থাকলে হয়রানির শিকার হন।
ড. মঈনুল ইসলামের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যখন রাজনৈতিক প্রভাবের আশ্রয়ে দুর্নীতি চালিয়ে যেতে পারেন, তখন কেবল তাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা যথেষ্ট নয়। বরং প্রশ্ন তুলতে হয়—কোন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি এত সুবিধা পেলেন?




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী

ইমেইল: nomanibsl@gmail.com

মোবাইল: 01713799669 / 01712596354

 

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।

© বিডি ২৪ নিউজ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  পটুয়াখালীতে র‍্যাবের গাড়ি ও বাসের সংঘর্ষে নিহত তিন   বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কের হাজিপুর সেতুতে নির্ধারিত টোলের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়   মেহেন্দীগঞ্জে জেলেদের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ,নিখোঁজ জেলের লাশ উদ্ধার   বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছর পর বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্তে আনন্দে নগরবাসী   বরিশালের ৬টি আসনে হেভিওয়েটের ছড়াছড়ি, থাকছে বিদ্রোহীর শঙ্কা   বরগুনায় সমাজসেবা উপপরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ   বিএনপি নেতা লিটনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা   পটুয়াখালীতে ‎৩৫তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা   সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে ইলিশ শিকারের দায়ে ১১ জেলের কারাদণ্ড   ভোলা উপকূলে ‘মা’ ইলিশ রক্ষায় রেড অ্যালার্ট, জেলেদের ঋণের কিস্তি নেয়ায় নিষেধাজ্ঞা   বরিশালে ভুয়া জেলে কার্ডের ছড়াছড়ি,প্রকৃত জেলেরা দুর্দশায়   বরিশালে উচ্ছেদ হলো আদালতের ন্যায়কুঞ্জে গড়া হোটেল   আমতলীতে ১৬ শিক্ষক-কর্মচারীর মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ১৫   বরিশালে বিএনপি নেতাসহ দুই ভাইয়ের ধর্ষণে এক গৃহপরিচারিকা অন্ত:সত্ত্বা   ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা   খুলনায় গুলি করে এক যুবককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা   বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত ধ্বংস করতে জাল নোট তৈরি, আ.লীগের নতুন পরিকল্পনা ফাঁস!   খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারায় সহিংসতার ঘটনায় তিন মামলা   টেকনাফ থেকে নারী-শিশুসহ ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার   দুর্নীতির মাস্টার বরিশাল শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার অসিত বরন দাস
Translate »