বিডি ২৪ অনলাইন নিউজ: খুলনা শহরের পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য বিগত ১/১১ সরকার আমলে খুলনা ওয়াসা যাত্রা শুরু করলেও নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি-এর পিছু ছাড়েনি। ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন সরকারি-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও খুলনা ওয়াসার কর্তারা রয়েছেন অধরা। এরই মধ্যে নতুন করে খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্পের ফেস-২ এর প্রায় ২৬ শ’ কোটি টাকার লুটপাটের জন্য চলছে মহাপ্রস্তুতি। প্রথম ফেস-এর সেই সাবেক কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। নগরীর আরও প্রায় ২৬ হাজার গ্রাহককে পানি দিতে পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-২ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় ওয়াসা। এবার ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৯৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক হাজার ৮২১ টাকা ঋণ এবং সরকার ৭৭৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়।
জানা যায়, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেসিসি’ সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক, খুলনা মহানগর যুব লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান পপলু ও কেসিসি’র সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্নার নেতৃত্বে ছিল একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট।
এর মধ্যে মেয়রের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনা ওয়াসর চেয়াম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। বাকী সদস্যরা ছিলের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। সেই সিন্ডিকেটের সহযাত্রী ছিলেন, খুলনা ওয়াসার বর্তমান উপব্যবস্থানা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ঝুমুর বালা, তত্ত্বাবধয়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ, সচিব/জেনারেল ম্যানেজার প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস, নির্বাহী প্রকৌশলী (১) বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের প্যানেলে আইইবি নির্বাচনে অংশ নেওয়া মো: রোজউল ইসলাম প্রমুখ। বিগত সরকার আমলে খুলনা ওয়াসার ফেস-১ এর নানা অনিয়ম এবং নিয়োগ, পদোন্নতি এবং দুর্নীতি হয়েছে তাদের নেতেৃত্বে হয়।
অভিযোগ ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের নামে। চায়না এই ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠনটির কাজ পায়িয়ে দেওয়া এবং ডেকে আনার নেপথ্যের মাধ্যম ছিলেন সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন। শেখ হেলালের হয়ে দেখভালের এবং কমিশন ও অর্থ লোপাটের নেপথ্যে ছিলেন, সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি (বর্তমানে আত্মগোপানে) তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক মেয়র কাজী আমিনুল হক, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান পপলু ও সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্না।
সেই চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনকে আবারও খুলনা ওয়াসার ফেস-২ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সাবেক কর্মকর্তারাই রয়েছেন মূল দায়িত্বে। ইতোমধ্যে দরপত্র/দরপ্রস্তাব উন্মুক্তকরণ কমিটি এবং দরপত্র/দরপ্রস্তাব উন্মুক্তকরণ ও মূল্যায়ন কমিটিতে সেই আলোচিত কর্মকর্তাদের নামের প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। তা পাশ হয়েছে এবং কমিটি কাজ শুরু করেছে। ২টি কমিটিতে ৯জন সদস্য রয়েছেন। তিন সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্ত কমিটির আহবায়ক হয়েছেন পরিচালক ঝুমুর বালা। তিনি একই সঙ্গে সাত সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক হয়েছেন।
একই ব্যক্তি দুই কমিটি থাকা মানে তার আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরবর্তী কমিটি কোনো পরিবর্তন করা লাগবে না। তেমনি তিন সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির সদস সচিব হয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ। তিনি আবার মূল্যায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রেজাউল ইসলাম দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব হয়েছেন। যদিও এধরনের বড় প্রকল্পে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ খুলনা ওয়াসাতে অনেক যোগ্য এবং দক্ষ কর্মকর্তা থাকলেও তাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। নিজস্ব সিন্ডিকেট ধরে রাখতে একই ব্যক্তিদের দুই কমিটিতে বিশেষ কায়দায় রাখা হয়েছে। গত ১৫ মে সাবেক এমডি এক পত্রে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর পত্র প্রেরণ করেছেন এবং সেই কমিটি অনুমোদন হয়ে কাজ শুরু করেছেন বলে, খুলনা ওয়াসার সচিব স্বীকার করেছেন।
খুলনা ওয়াসার ফেস-১ এর প্রকল্পের ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হলেও খুলনাবাসী কাঙ্খিত সুফল পায়নি। এর মূল কারণ ছিল দুর্নীতি আর অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ। ফলে খুলনাবাসীকে বছরের অধিক সময়ে লবণ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই প্রকল্পের কারণে নগরীর পয়নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং সড়কগুলো আজ বেহাল অবস্থায় পড়েছে। যার মেরামত এবং সংস্কার কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ওপর।
প্রায় একই ধরনের ফেস-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং গত চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সেটি একনেকে অনুমোদন হয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছেন সাবেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। এবারও সেই আলোচিত চায়না ইঞ্জিনিয়াংি কর্পোরেশনকে টেন্ডার ড্রপিংয়ের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন গত ২০০১৮/১৯ সালে নিয়োগ পেয়েছিল। এই কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতি কাজের অনিয়ম সময়মত কাজ শেষ না করাসহ হাজার অভিযোগ নগরবাসীর। তারপরেও কিভাবে সিডিউল ক্রয় করে সাবমিট করল, প্রশ্ন সকল মহলের। তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ ও প্রকৌশলী রেজাউল ইসলামের হাত ধরে চায়না বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবারও নতুন প্রজেক্টে টেন্ডার নিতে চায় ফেস-২ প্রকল্পের। প্রকৌশলী মোঃ রেজাউল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি তার প্রকল্পের কাজে টেন্ডার জালিয়াতি করেছেন বলে জানা যায়।
এ ধরনের দুর্নীতি দায় অভিযুক্ত ব্যক্তি বৃহৎ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে, এই মেগা প্রকল্পটির টেন্ডার প্রক্রিয়াটি মুখ থুবড়ে পড়বে। চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ফেস-২ এ বৃহৎ প্যাকেজ -১ এ টেন্ডার করেছে গত ২৫ সেপ্টেম্বর। ইতোমধ্যে চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনসহ আরো সাতটি কোম্পানি এই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সাবমিশন করেছে।
উল্লেখ্য, খুলনা ওয়াসা যাত্রা শুরুর অল্প কিছু দিন পর ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে ১/১১ সরকারের আনুকূল্যে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নজরদার শুরু করেন খুলনা ওয়াসার ওপর। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর তালুকদার আব্দুল খালেক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খুলনার ওয়াসার চেয়ারম্যানের হন। অবৈতনিক পদ হলেও তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু। আর তার পেছনে ছিল খুলনার আলোচিত শেখ বাড়ি।
শেখ বাড়ি হলো আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার চাচা শেখ আবু নাসেরের বাড়ি। যে বাড়ির কর্ণধার ছিলেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন। ওই বাড়িতে আরও ছিলেন, শেখ হাসিনার অপর চাচাতো ভাই সাবেক এমপি সেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, শেখ সোহেল ও শেখ রুবেল। বলতে গেলে খুলনার অঘোষিত গণভবন ছিল শেখ বাড়ি। সেখান থেকেই খুলনা বিভাগের সকল নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারসহ রাজনৈতিক হয়রানির চূড়ান্ত নির্দেশনা আসতো। সেই শেখ বাড়ির আশির্বাদপুষ্ট কর্মকর্তরাই ছিলেন খুলনা ওয়াসার নিয়ন্ত্রক। তারাই এখন ফেস-২ এর দায়িত্বে পেতে যাচ্ছেন।
খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেস -১ এর টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ। এবার ফেস-২ প্রকল্পের প্রস্তাবিত টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাসকে। এছাড়া প্রকল্পের দরপত্রপ্রস্তাব এবং মূল্যায়ন কমিটিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ঝুমুর বালা, নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রেজাউল করিমসহ সাবেক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বিলুপ্ত হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্রতিনিধিরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তার কোনো দৃশ্যমান কাজ নেই। ফলে খুলনা ওয়াসার আওয়ামী আমলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওয়াসার নীতি নির্ধারনীসহ সকল প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে লুটপাটের মহাপ্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ফেস-২ প্রকল্পে ১০ টি প্যাকেজে এ কাজ সম্পন্ন হবে। দাতা সংস্থা এডিবি’র শর্ত অনুযায়ী প্রথম দফায় ৪টি প্যাকেজর কাজ চলমান। এর মধ্যে প্রকল্পের কনসালটেন্ট নিয়োগ, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ রয়েছে। তবে প্রকল্প পরিচালক পদের জন্য যে যোগ্যতা দরকার তা খুলনা ওয়াসাতে তেমন কর্মকর্তা নেই। একইভাবে কনসালটেন্ট নিয়োগ করতে হবে বাইরে থেকে। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল পার্সনদের নিয়ে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তার মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করবে। নিজেকে কমিটি থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব শুধু সমন্বয় করা।