
বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: সরকারি চাকরির সীমিত বেতন ও বিধিবদ্ধ সুবিধার বাইরে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী কীভাবে কয়েক বছরের মধ্যে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যেতে পারেন-এই প্রশ্ন এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভেতরে এবং বাইরে সমানভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহ আলম ফারুক চৌধুরী, যিনি ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে টানা ছয় বছর ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-২ এ দায়িত্বে থেকে নানা অনিয়ম, টেন্ডার কারসাজি ও আত্মীয়প্রীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কুমিল্লার সন্তান শাহ আলম ফারুক চৌধুরী ছাত্রজীবনে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা। দলীয় পরিচয়ের সুবাদে তিনি খুব অল্প সময়েই গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হন।
২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর তিনি ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-২-এ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। স্বাভাবিক নিয়মে তিন বছরের বেশি একই স্থানে থাকা নিয়মবহির্ভূত হলেও, তিনি পরপর ছয় বছর একই পদে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন, ধানমন্ডি ৩২ ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনের কাজ নিজের তত্ত্বাবধানে রাখেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এই সময়েই তিনি “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাজসজ্জা ও রক্ষণাবেক্ষণ” প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ শত কোটি টাকার ব্যয় দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেন। সেই সময় গণভবনের সাজসজ্জা, ধানমন্ডি ৩২-এ জাতির জনকের বাড়ির সংস্কার, এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে প্যান্ডেল সাজানোর নামে বিপুল পরিমাণ বিল প্রদানের প্রমাণ মিলেছে। প্রকৌশলী হয়েও শাহ আলম ফারুক সরাসরি বা পরোক্ষভাবে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার পিয়ারু সর্দার ও তার নাতি তানভীর নিয়মিতভাবে গণভবন ও ধানমন্ডি ৩২-এর সাজসজ্জা ও আলোকসজ্জার কাজ পেয়ে আসছেন।
অভিযোগ রয়েছে, এই পরিবারটি প্রকৃতপক্ষে কাজ না করেও বিল তুলে নেয়—আর সেই বিল অনুমোদনে শাহ আলম ফারুক সরাসরি ভূমিকা রাখেন। তানভীর ছিলেন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর সঙ্গে যুক্ত, যা ক্ষমতাসীন দলের প্রচারমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এই সংযোগের কারণেই তিনি গণপূর্তের অর্ধডজন বড় প্রকল্পে কাজ পেয়েছিলেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে, যুবলীগ নেতা তাজবিরুল ইসলাম অনু-র সঙ্গে শাহ আলম ফারুকের ব্যবসায়িক সম্পর্কও বহুল আলোচিত। অনু গণপূর্তের “নামমাত্র কাজ” দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নিয়েছেন, যা শাহ আলম ফারুকের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) পোর্টালে ২০২২-২৩ অর্থবছরের নথিপত্র পরীক্ষা করলে দেখা যায়, দুই দিনের মধ্যে কাজ শেষ দেখিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, স্বল্প মূল্যের কাজ সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু শাহ আলম ফারুক প্রায় সব প্রকল্পেই প্রয়োগ করেছেন, যাতে নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের অগ্রাধিকার দেওয়া যায়।
সূত্রমতে, তিনি প্রতিটি কাজের বিনিময়ে গড়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন আদায় করতেন। এই কমিশন নগদে বা চুক্তিভিত্তিক বিলের অংশ হিসেবে ভাগ করা হতো। ২০২৩ সালের ২২ জুন অফিস বন্ধ থাকলেও, তার দপ্তরের ইজিপি পোর্টালে ২৮ জুন দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়—যা স্পষ্টতই সরকারি বিধি লঙ্ঘন।
একাধিক প্রকৌশলী জানান, “তিনি কাজের প্রাক্কলন তৈরি হওয়ার আগেই টেন্ডার আহ্বান করেন এবং নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের জন্য শর্ত সাজিয়ে রাখেন।”
২০২৪ সালে শাহ আলম ফারুককে বাগেরহাট গণপূর্ত বিভাগে বদলি করা হয়। কিন্তু সূত্র জানায়, তিনি সপ্তাহে এক-দুই দিনের বেশি অফিসে উপস্থিত থাকেন না। অধিকাংশ সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করে মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন—ঢাকা পোষ্টিং পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে।
তার কুমিল্লার ‘রাজনৈতিক সংযোগ’ ব্যবহার করে তিনি খুলনা সার্কেলের এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আনোয়ারুল নজরুলের সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আনোয়ারুল নজরুলের সহযোগিতায় তিনি বাগেরহাটে টেন্ডার উৎসব শুরু করেছেন। বর্তমানে সেখানে প্রায় দশটি বড় দরপত্র চলমান রয়েছে, যেগুলোর ৭০ শতাংশের বেশি ঙঞগ পদ্ধতিতে আহ্বান করা হয়েছে।
দুর্নীতির এই দীর্ঘ ছয় বছরে শাহ আলম ফারুক চৌধুরী অস্বাভাবিক হারে সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। অভিযোগ অনুযায়ী-ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট ও ভবন; কুমিল্লায় প্রায় ২৩ একর জমি; এবং বিভিন্ন ব্যাংকে নিজের ও পরিবারের নামে শত শত কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এই বিপুল সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোনো সরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “তিনি এত দ্রুত ধনী হয়েছেন যে অনেক ঠিকাদার এখন তাকে ‘শাহ আলম সাহেব’ নয়, ‘শাহ আলম কর্পোরেশন’ বলে ডাকেন।” খুলনা গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আনোয়ারুল নজরুল শাহ আলম ফারুকের এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে একাধিকবার সাংবাদিকদের ফোন কলের জবাব দেননি। স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা জানান, বাগেরহাট গণপূর্ত অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে শাহ আলম ফারুক কতদিন অফিসে উপস্থিত থাকেন।
একজন স্থানীয় ঠিকাদার জানান, “শাহ আলম ফারুক স্যারের অনুমোদন ছাড়া এখানে কোনো টেন্ডার হয় না। অফিসের সবাই জানে তিনি ঢাকায় থেকে ফোনে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।” অভিযোগ রয়েছে, শাহ আলম ফারুক চৌধুরী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হওয়ার সুবাদে প্রভাবশালী আওয়ামী নেতা শেখ সেলিমের আশীর্বাদ পেয়ে আসছেন। গণভবনের কাজ ভাগ করে দেওয়ার সময় বড় কমিশনের অংশ নিয়মিতভাবে ‘উপরে’ পৌঁছে যেত বলে অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়। এই প্রভাবের কারণেই তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দপ্তরের সহকর্মীদের ভাষায়, শাহ আলম ফারুক এখন “একজন ঠিকাদারি ব্যবসায়ী”, প্রকৌশলী নয়। সরকারি চাকরি করেও তিনি বিলাসবহুল গাড়ি, উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট, পরিবারের বিদেশ সফর, এমনকি বিদেশি ব্যাংক একাউন্টের মতো সুবিধা ভোগ করেন।
ঢাকার একটি নামি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “তার নামে এবং স্ত্রী-সন্তানের নামে একাধিক ফিক্সড ডিপোজিট আছে, যার পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকার কাছাকাছি।”
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরে এসেছে বলে জানা গেছে। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়নি।দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, “যদি লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়, তবে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হবে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার আয় ও সম্পদের মধ্যে অসামঞ্জস্য থাকলে তা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের আওতায় তদন্ত করা হবে।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তারা মুখ খুলতে রাজি নন। কেউ কেউ জানান, “উপরমহলে তার প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে, সাধারণ কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কথা বললে বদলি বা হয়রানির মুখে পড়েন।”অন্যদিকে, প্রকৌশলীরা বলছেন—এই ধরনের দুর্নীতির কারণে প্রকৃত যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একজন সিনিয়র প্রকৌশলী বলেন, “যখন একজন কর্মকর্তা ছয় বছর একই পদে থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান, তখন পুরো সিস্টেমটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।”
শাহ আলম ফারুকের মাধ্যমে পরিচালিত টেন্ডার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত আছেন কিছু প্রভাবশালী ঠিকাদার, রাজনৈতিক কর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ী। অভিযোগ রয়েছে, তারা একে অপরের নামে টেন্ডার জমা দেন, দরপত্রে প্রতিযোগিতা দেখিয়ে পরস্পরকে সুবিধা দেন এবং পরে কাজের বিল ভাগ করে নেন।
ইজিপি পোর্টালের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, একই ঠিকাদার একাধিক প্রকল্পে নাম বদলে অংশ নিয়েছেন এবং একাধিক দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও কাজ পাননি—যা অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়।
গণপূর্ত অধিদপ্তর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠান। সেখানে এক বা একাধিক কর্মকর্তা যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন, তবে এর দায় কেবল ব্যক্তিগত নয়—পুরো প্রশাসনের ওপর পড়ে।
প্রশাসনিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “একজন প্রকৌশলী যদি নিজের পদ ব্যবহার করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন নেয় এবং নিজের সম্পদ গড়ে, তবে সেটি শুধু দুর্নীতি নয়—রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর আঘাত।”
তাদের মতে, দুদকের দ্রুত তদন্ত, সম্পদের উৎস যাচাই এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
মোঃ শাহ আলম ফারুক চৌধুরী গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা হয়েও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, ঠিকাদারি বানিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে এক অস্বচ্ছ ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো যদি প্রমাণিত হয়, তবে এটি হবে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় সরকারি দুর্নীতির কেলেঙ্কারি।
জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা এই রাষ্ট্রীয় দপ্তরকে রক্ষা করতে হলে—এমন সব অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াই এখন একমাত্র পথ।