মঙ্গলবার ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   মঙ্গলবার ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


গলাচিপায় পঙ্গুত্বকে হার মানালেন ফাল্গুনী
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর, ২০১৯, ৫:২১ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

গলাচিপায় পঙ্গুত্বকে হার মানালেন ফাল্গুনী

সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ
হাত দুটি নেই বললেই চলে। পরিবারের চরম আর্থিক সংকট, অসময়ে বাবার মৃত্যু
ইত্যাদি কত চ্যালেঞ্জ। পটুয়াখালীর গলাচিপার প্রত্যন্ত গ্রামের একটা মেয়ের জন্য সেগুলো হিমালয়সম; কিন্তু তাতে দমে যাননি ফাল্গুনী। এখন তিনি একটি বেসরকারি কম্পানির হিউম্যান রিসোর্স অফিসার। ফাল্গুনীর সংগ্রামের গল্প বলছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
চার বোনের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। আর দশটি শিশুর মতোই হেসে-খেলে বেড়ে উঠছিলেন। ২০০২ সাল। ফাল্গুুনী তখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। পাশের বাড়ির ভবনের ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলেন। হঠাৎ বিদ্যুতের তারের সঙ্গে শক লেগে তাঁর হাতের কনুই পর্যন্ত পুড়ে যায়। আর্তচিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে প্রথমে গলাচিপা সদর হাসপাতালে, পরে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যায়। দেশের চিকিৎসা কাজে দিচ্ছিল না। একসময় কলকাতায় নেওয়া হলো। কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি নিতে চায়নি। পরে অনেক কষ্টে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তত দিনে ফাল্গুনীর হাতে পচন ধরে যায়। সেখানকার ডাক্তার বললেন, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এভাবে পচতে থাকলে একসময় ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। তাই হাত আর রাখা যাবে না।’ যা হোক, কনুই থেকে কেটে ফেলা হলো ফাল্গুনীর দুই হাত।
লিখতে শিখলেন
হাতের ঘা শুকাতে মাস চারেকের মতো লাগল। প্রতিবেশীরা আফসোস করে বলত, মেয়েটার আর পড়াশোনা হবে না। কিন্তু ফাল্গুনী দমে যাওয়ার পাত্রী নন। কাগজ-কলম দেখলে মন খারাপ হতো। সহপাঠীদের স্কুলে যেতে দেখলে চোখের কোণে জল আসত। ভাবতেন, ‘পৃথিবীতে কিছুই তো অসম্ভব নয়। তবে আমি কেন পারব না?’ একদিন সাহস করে কলম কামড়ে ধরলেন। খাতার ওপর লিখতে চেষ্টা করলেন। এভাবে কিছুদিন প্র্যাকটিস করলেন। পরে একদিন দুই হাতের কনুইয়ের মাঝখানে কলম রেখে লেখার কৌশল আয়ত্তের চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘শুরুতে ভীষণ কষ্ট হতো। এলোমেলো হয়ে যেত লাইন। কলম ধরতে ধরতে একসময় হাতে ইনফেকশনও হয়েছিল। ডাক্তারও বারণ করেছিলেন এভাবে লিখতে।’ কিন্তু ফাল্গুনী হার মানবেন কেন? অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে একসময় ঠিকই লেখা আয়ত্তে চলে আসে।
আবার শুরু হলো স্কুলে যাওয়া
পরের বছর তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। গলাচিপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলেন। গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ফাল্গুনীর কথা জানাজানি হলে ঢাকার ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদ তাঁকে ঢাকায় এনে ট্রাস্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। কলেজের হোস্টেলেই থাকতেন। এখান থেকে এইচএসসিতে মানবিকে জিপিএ ৫ পেয়ে ফাল্গুনী প্রমাণ করলেন, মানুষ চাইলে সবই পারে! তিনি বললেন, ‘পরীক্ষাকেন্দ্রে আমার জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুই কনুইয়ের মধ্যে কলম চেপে ধরে লিখতাম।’
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের সময় ফার্মগেটে ছিলেন কিছুদিন। পরে সূত্রাপুর ও লালবাগে দুই আত্মীয়ের বাসায় থেকেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। অনার্সে সিজিপিএ ৩.৫০ পেয়েছেন। এখন সেখানে মাস্টার্সে পড়ছেন।
অসময়ে বাবাকে হারালেন
ফাল্গুনীর বাবা জগদীশচন্দ্র সাহা, মা ভারতী সাহা। ছোটখাটো একটি মুদি দোকান ছিল জগদীশের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পর বাবাকে হারিয়েছেন। তখন ফাল্গুনী সবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছেন আর তাঁর ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী। দুই মেয়েকে নিয়ে ভারতী সাহা যেন অথৈ জলে পড়লেন। মিষ্টির বাক্স বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে এ কাজে মাকে সাহায্য করতেন ফাল্গুনী। বললেন, ‘বাবার হার্টে ব্লক ছিল। পরে জেনেছি, টাকার অভাবে তিনি ঠিকমতো ওষুধ কিনতেন না। কিন্তু বাবা কখনো কষ্টের কথা বুঝতে দেননি।’
দিনগুলো কঠিন ছিল
প্রথম বর্ষে পড়ার সময় সাভারে একটি টিউশনিও পেয়েছিলেন মাসে দেড় হাজার টাকায়। কিন্তু মাস দুয়েকের বেশি চালিয়ে নিতে পারেননি। কারণ, অভিভাবকদের ধারণা, ‘আমার হাত দুটি নেই। লিখতেও কষ্ট হয়। তাই আমি পড়াতে পারব না!’ টিউশনি চলে যাওয়ার পর চরম অর্থকষ্টে কাটে কিছুদিন। পরে এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী চন্দ্র নাথের সঙ্গে। সেখান থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা হলো। ফাল্গুনী বললেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি মাসে যা পেতাম তা দিয়ে খরচ মিটে যেত। সত্যি বলতে কী, ওই সময় বৃত্তি না পেলে হয়তো পড়াশোনায়ও ইস্তফা দিতে হতো। পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।’
এবার চাকরি পেলেন
ফাল্গুনীর এখনো মাস্টার্স শেষ হয়নি। বলছিলেন, ‘পড়াশোনার সময় তো বৃত্তির টাকায় চলেছিলাম। কিন্তু মাস্টার্স শেষে কী হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’ এর মধ্যেই গত ১৭ অক্টোবর পেলেন সুখবর। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকে হিউম্যান রিসোর্স অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আগামী মাসের ৩ তারিখে যোগদান করার কথা। বললেন, ‘মা অনেক অসুস্থ। বসে বসে কাজ করতে গিয়ে তাঁর হাড় ক্ষয়ে গেছে। কিছুদিন আগে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছেন। মাকে ভালো ডাক্তার দেখাব। ছোট বোন এখন অনার্সে পড়ছে। তাকেও সাপোর্ট দিতে চাই।’




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী

ইমেইল: nomanibsl@gmail.com

মোবাইল: 01713799669 / 01712596354

 

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।

© বিডি ২৪ নিউজ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  বরিশালের ১৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা   বরিশালে অপসাংবাদিকতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ ৩৫ সংগঠন   আটকে আছে ১৭শ কিলোমিটার সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন কাজ   বরিশালের রাঙামাটি নদী থেকে হাত-পা বাঁধা যুবকের লাশ উদ্ধার   সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে লাপাত্তা ডিআইজি এহসানউল্লাহ   বরিশালের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা ঘুস নিয়ে বদলীর অভিযোগ   বরিশালে ফরচুন মিজানের ভাই রবিউল আটক   দালাইলামা মডেলে হাসিনাকে নিয়ে নানা পরিকল্পনা দিল্লির   শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর বরিশালে বাস্তবায়ন করছে ৭শ’ কোটি টাকার প্রকল্প   বরিশালের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বদলী বাণিজ্যের অভিযোগ   চলন্ত বিআরটিসি বাসে অগ্নিকাণ্ড,সব যাত্রী নিরাপদে   কাজ ফেলে পালিয়েছে মাফিয়া আমু’র ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার   জেলের স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে হিজলা মৎস্য কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণ   বরগুনার কৃষি কর্মকর্তার অফিসই বাসা!   বরিশালে ভাই-ভাই দ্বন্দ্বে বড়ভাইকে মারধর   বাগেরহাটে বিএনপি নেতা ওয়াহিদুজ্জামান দিপুর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড   অর্থ কেলেঙ্কারীতে আটক হওয়া সাইদুর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে   বাসের ধাক্কায় বিএনপি নেতা নাসিম আকন নিহত   বানারীপাড়ায় তিন বিএনপি নেতার নামে চাদাঁবাজী মামলা   গণপূর্তের কমিশন কিং প্রকৌশলী শাহ আলম ফারুক
Translate »