
বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়ংকর শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সরকারি টাকায় কেনা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এই চক্রের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন এক কেলেঙ্কারি, যা শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়- বরং সাধারণ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার ঝুঁকিও তৈরি করেছে।
দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, বন্দর বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক এস. এম. সাইফুল ইসলাম ও উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী মিলে দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন সাবেক এমপি আলি আজগর, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের ব্যক্তিগত সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ, এবং ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম। এই সিন্ডিকেট ১৮ লাখ টাকার নিম্নমানের লিফট সরবরাহ করে সরকারের কাছ থেকে নিয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা দামে, প্রতিটি প্রকল্পে।
“এ” গ্রেডের নামে “ডি” গ্রেডের সরঞ্জাম :
সরকারি টেন্ডার নথি অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মানের ‘এ গ্রেড’ লিফট সরবরাহের শর্ত ছিল। লিফটগুলো হতে হবে ইউরোপ বা জাপানের বিখ্যাত ব্র্যান্ড যেমন- ফুজিটেক, হিটাচি, মিৎসুবিশি, কোনে, ওটিস বা শিন্ডলার। প্রত্যেকটি লিফটের দাম ধরা হয় আনুমানিক ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ করা হয়েছে চীনা কোম্পানি “ফুজাও এলিভেটেড কো. লি.”-এর লিফট, যার বাজারমূল্য মাত্র ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকার মধ্যে। বন্দরের ৪ নম্বর গেটের “ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিল্ডিং”-এ স্থাপিত চারটি লিফটে লেখা আছে ফুজিও চায়না। সরেজমিনে দেখা যায়, ওই লিফটগুলো বারবার বিকল হচ্ছে, আটকে যাচ্ছে মাঝপথে, এমনকি একাধিকবার যাত্রী আটকে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। গণপূর্তের বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই লিফটগুলো ‘এ’ গ্রেড নয়- এগুলো ‘সি’ বা ‘ডি’ গ্রেড। এতে ইউরোপীয় কন্ট্রোল ইউনিট, গিয়ারলেস মোটর, কার্বন স্টিল রোপ- কিছুই নেই।”
টেন্ডারে কারসাজি :
সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী, লিফট কেনা একটি পণ্য শ্রেণির (এড়ড়ফং) প্রকল্প হওয়া উচিত। তাতে আন্তর্জাতিক মান যাচাই, তৃতীয় পক্ষের পরীক্ষণ, সার্টিফিকেশন- এসব বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাইফুল-মেসবাহ সিন্ডিকেট তা এড়িয়ে যেতে টেন্ডার শ্রেণি পরিবর্তন করে ‘ওয়ার্কস’ করে ফেলে- অর্থাৎ লিফট কেনাকে ভবন নির্মাণের কাজ হিসেবে দেখানো হয়! এভাবে তারা আন্তর্জাতিক মান যাচাই ও প্রযুক্তিগত পরীক্ষণ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। বন্দরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “ওয়ার্কস শ্রেণিতে নেওয়াই ছিল পুরো দুর্নীতির মূল চাবিকাঠি। এতে প্রতিযোগিতা সীমিত হয়ে যায়, আর নির্দিষ্ট ঠিকাদারই কাজ পায়।” ফলাফল- চুক্তি অনুযায়ী চার কোটি ৫৮ লাখ টাকায় কেনা চারটি লিফটের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ৭২ লাখ টাকা। বাকি টাকা ভাগ হয় সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে- পরিচালক সাইফুল ইসলাম, মেসবাহ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ, আলি আজগর, এবং ঠিকাদার জাহাঙ্গীর আলম।
ছয় প্রকল্পে সাত কোটিরও বেশি লোপাট :
২০২২ সালে এই সিন্ডিকেট অন্তত ছয়টি প্রকল্পে একই কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
১. “ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিল্ডিং” ৪টি লিফট (ডি গ্রেড)।
২. “বন্দর হাসপাতাল সংলগ্ন অফিসার্স কোয়ার্টার” – ২টি লিফট (বি গ্রেড)
৩. “অফিসার্স ডরমিটরি” – ১টি লিফট (সি গ্রেড)
৪. “স্টোর বিল্ডিং” – ১টি লিফট (সি গ্রেড)
৫. “কার শেড” – ১টি লিফট (ডি গ্রেড)
৬. “প্রশাসনিক ভবন” – ১টি লিফট (নিম্নমানের)
সব মিলিয়ে প্রকল্পগুলোর বাজেট প্রায় ১২ কোটি টাকা।
সরকারি মূল্যায়ন অনুযায়ী, প্রকৃত পণ্যের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ সিন্ডিকেটের সদস্যরা সাত কোটি টাকারও বেশি সরকারি অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একজন ঠিকাদার (যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন,“বন্দরে এখন টেন্ডার মানে আগেই নির্ধারিত থাকে কে কাজ পাবে। বাকিরা শুধু ফরমালিটি। সবকিছু সিন্ডিকেটে বন্টন হয়ে যায়।”
সাইফুল ও মেসবাহ ‘কেন্দ্রে’, জাহাঙ্গীর ‘অপারেটর’ :
বন্দর বিদ্যুৎ বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন পরিচালক এস. এম. সাইফুল ইসলাম। উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী সরাসরি কারিগরি অনুমোদনের দায়িত্বে। তারা দুজন মিলে দরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন এমনভাবে তৈরি করেন যাতে কেবল জাহাঙ্গীর আলমের প্রতিষ্ঠান এ এন্ড জে ইন্টারন্যশনাল-ই উপযুক্ত হয়। এদিকে সাবেক এমপি আলি আজগর তার রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রকল্প অনুমোদন ও বিল ছাড়ে সহায়তা করেন। আর সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের ব্যক্তিগত সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ পুরো লেনদেন ও বিল পাসের দালালি করেন। অর্থাৎ- সাইফুল অনুমোদন দেন, মেসবাহ নথি তৈরি করেন, জাহাঙ্গীর নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করেন, আরশাদ বিল ছাড়িয়ে নেন, আলি আজগর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব দেন।
সরবরাহকৃত লিফটের ভয়াবহ অবস্থা :
২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকেই বন্দরের ভবনগুলোতে স্থাপিত লিফটগুলোতে বারবার ত্রুটি ধরা পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দরজা হঠাৎ আটকে যায়, কিছু লিফটে “ফ্লোর সেন্সর” কাজ করে না, এমনকি হঠাৎ নিচে নেমে যাওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। গণপূর্তের এক প্রকৌশলী বলেন- “একটি সরকারি ভবনে এই ধরনের লিফট দুর্ঘটনা ঘটলে তা ভয়াবহ হবে। কারণ এগুলোতে জরুরি ব্যাকআপ বা নিরাপত্তা সেন্সর নেই।” বন্দর কর্মচারীরা জানান, নতুন লিফট হওয়া সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহেই সার্ভিসিং করতে হয়। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থার কোনো প্রতিনিধি নিয়মিত আসে না।
প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা :
অনুসন্ধানে জানা যায়, “ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিল্ডিং”-এর লিফট সংক্রান্ত প্রাথমিক নথিগুলোর কয়েকটি ফাইল হঠাৎ উধাও হয়েছে। বন্দর প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “দরপত্র নথিতে কিছু পৃষ্ঠায় হোয়াইট করা, কিছু জায়গায় আলাদা কলমে লেখা- স্পষ্টত কারসাজির প্রমাণ।” একই সময় দেখা যায়, প্রকল্প অনুমোদনের তারিখ ও বিল পাসের তারিখ প্রায় একই। অর্থাৎ, সরঞ্জাম সরবরাহের আগে থেকেই বিল প্রস্তুত ছিল। এতে বোঝা যায়, কাজ শুরুর আগেই অর্থ ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল। এসব বিষয়ে জানতে ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম-এর মোবাইলে কল করা হলে তিনি প্রথমে ফোন রিসিভ করে বলেন, “আমি তো প্রকৌশলী নই। কোন লিফট সরবরাহ হয়েছে, সেটা প্রকৌশলীরা বলতে পারবেন।” কিন্তু পরে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি না জানলে কে জানবে?”, তখন তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরিচালক এস. এম. সাইফুল ইসলাম বলেন, “আপনারা সরেজমিনে দেখে লিখুন। সরবরাহকৃত লিফটের মান যদি টেন্ডার অনুযায়ী না হয়, তবে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।” তবে বাস্তবে দেখা গেছে, ওই লিফটগুলো ইতোমধ্যে সরকারি ভবনে স্থাপন করা হয়েছে এবং কার্যক্রম চালু রয়েছে। উপপ্রধান প্রকৌশলী মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে বারবার কল করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। অফিসে গিয়ে দেখা করলে তিনি মন্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন- “বন্দরের মতো কৌশলগত প্রতিষ্ঠানে ‘এ’ গ্রেডের নামে ‘ডি’ গ্রেড সরঞ্জাম সরবরাহ শুধু দুর্নীতি নয়, এটি জননিরাপত্তারও হুমকি। এক কোটি ১৫ লাখ টাকার লিফট যদি ১৮ লাখে কেনা যায়, তাহলে বাকি টাকা গেছে কোথায়?” তিনি আরও বলেন, “এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ফল। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত এখনই টেকনিক্যাল অডিট ও আর্থিক তদন্ত শুরু করা।” বন্দর প্রকৌশল বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা মনে করেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বাধীন টেকনিক্যাল অডিট টিম গঠন করা উচিত। যারা প্রত্যেকটি লিফটের মান, নিরাপত্তা, এবং আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন যাচাই করবেন। তারা বলেন, “যদি এভাবে নিম্নমানের সরঞ্জাম লাগানো হয়, তাহলে বন্দরের শত শত কর্মচারী ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতিও হবে।”
সিন্ডিকেটের পরবর্তী পরিকল্পনা ও বিদেশে অর্থ পাচার :
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেটভুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা সম্প্রতি বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে দুজনের নামে ব্যাংক লেনদেন ও সম্পদ হস্তান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, তারা দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার করতে চাইছেন। বন্দরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “দুর্নীতি শুধু অর্থের নয়, এখানে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। এই সিন্ডিকেটকে থামানো না গেলে ভবিষ্যতে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” সেখানে যদি ১৮ লাখ টাকার লিফট ১ কোটি ১৫ লাখ টাকায় কেনা হয়, তবে সেটি শুধু অর্থ নয়- রাষ্ট্রীয় নৈতিকতারও অপচয়।
এই দুর্নীতির মূল হোতা পরিচালক এস. এম. সাইফুল ইসলাম, তার সহযোগী মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আলি আজগর, লিঙ্কম্যান ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ, এবং প্রধান ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম। তাদের যোগসাজশে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, মানহীন লিফট স্থাপন, নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি এবং নথি বিকৃতি- সব প্রমাণই হাতে এসেছে। নাগরিক সমাজ, প্রকৌশল মহল এবং সাধারণ মানুষ একটাই প্রশ্ন তুলছেন- “রাষ্ট্রের টাকা যদি এমনভাবে ভাগ হয়, তাহলে উন্নয়ন কোথায় যাবে?” চট্টগ্রাম বন্দরের এই লিফট কেলেঙ্কারি এখন দুর্নীতিবিরোধী তদন্তের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। সরকার চাইলে এখান থেকেই প্রমাণ করতে পারে- দুর্নীতি যত বড়ই হোক, তা আর নিরাপদ নয়।