
বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: মেঘনা নদী ঘেরা বরিশালের হিজলা উপজেলায় সদ্য নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়া “মা ইলিশ” রক্ষা অভিযান সবচেয়ে বেশী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে উপজেলা মৎস্য বিভাগ।
দিনে-রাতে হাজার হাজার জেলে নৌকা প্রকাশ্যে ইলিশ নিধন ও বেচা বিক্রি করলেও লোক দেখানো “আকাশে ড্রোন এবং ফায়ার সার্ভিসের জলকামান” ব্যবহারের হাকডাক শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিলো।
উল্টো মৎস্য বিভাগ মা ইলিশ শিকারে বিরোধীতাকারী প্রভাবশালী সামাজিক ব্যক্তিবর্গ ও গণমাধ্যমকর্মীদের আড়াল করে মেঘনা নদীর জেলে লালন-পালনকারী নদী তীরের শত শত মাছঘাটের এক ডজনেরও বেশি মালিকদের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে মৎস্য বিভাগ নদীতে “ভিডিও ধারনের জন্য” অভিযান পরিচালনা করলেও মা ইলিশ রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছে নমৎস্য সমিতির নেতারা।
তারা জানিয়েছেন- সদ্য সমাপ্ত মা ইলিশ রক্ষা অভিযান এ বছর শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।যা বিগত বছর গুলোতে হয়নি। মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন রনকৌশলের হাকডাক দিয়ে (জাল ও জেলে শূণ্য মেঘনা নদী রাখার ঘোষণা)ইলিশ দস্যু মেঘনার নিয়ন্ত্রক একডজন মাছ ঘাট মালিকদের বেপরোয়াভাবে মা ইলিশ নিধনে সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছেন। এমনকি প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় হিজলা উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী এবং আশপাশের প্রতিটি বাজারে লাখ লাখ টাকা মা ইলিশ বেচাকেনা করেছেন মাছ শিকার ও ব্যবসায় জড়িতরা।
মৎস্যসমিতি ও নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, উপজেলা মৎস্য বিভাগ নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে নদীতে অভিযান পরিচালনা করলেও প্রতিদিন নিদিষ্ট কয়েকটি স্পটেই মহড়া দিয়েছেন। মেঘনাতীরের মৎস্য ব্যবসায়ীদের সরবরাহকৃত “টোকেন” যেসমস্ত জেলে প্রদর্শণে ব্যর্থ হতেন তাদেরকেই মূলত আটক করে ভ্রাম্যমানআদালতে সোপর্দ করতেন অভিযানিক দল।স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন একহাজার টাকা করে একজন জেলে ২২ দিনে ২২ হাজার টাকার বিনিময়ে “মা ইলিশ” নিধনের বৈধতা পেয়েছেন। উপজেলা মৎস্য বিভাগ ও মেঘনার মৎস্য ব্যবসায়ীদের এমন সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে-ই মূলত শেষ হয়েছে এবছরের “মা-ইলিশ” শিকার নিষেধাজ্ঞার ২২ দিন।চারদিকে ঘেঁষা হিজলা উপজেলার গৌরব্দী ইউনিয়নের অরাকুল গ্রামের জেলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান ,মাছ ঘাটের মালিক মোস্তফা সিকদার, আলম শরীফের মাধ্যমে ২২ হাজার টাকা দিয়ে একটি “টোকেন” সংগ্রহ করেছি। বিনিময়ে তাদেরকে মাছ দিতে হয়েছে।
ওই জেলে আরও বলেন, দিনে-রাতে যখনই মাছ ধরতে গিয়েছি কখনই অভিযানিক দল আমাদেরকে আটক করেনি।যারা টোকেন দেখাতে পারেনি তাদেরকে আটক করে সাঁজা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে।এমনকি তাদের জাল ও নৌকা অন্য জেলেদের কাছে নগদ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন।
এমন-ই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা রবিবার (২৬ অক্টোবর)প্রকাশ্যে আসলে গোটা উপজেলাব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। দুই সপ্তাহ বরিশাল কারাগারে হাজতবাসের পর স্বামী বাড়ী ফেরার পর মোসা.রহিমা বেগম নামে এক নারী উপস্থিত হন হিজলা উপজেলা নির্বাহীকর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইলিয়াস সিকদারের কার্যালয়ে।
রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘুষ আদায়কারী মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলমের উপস্থিতিতে ও উপজেলা প্রশাসনের একাধীক দপ্তরের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থানকালে ভুক্তভোগী নারী মোসা. রহিমা বেগম তার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের কথা বলেন।তিনি জানান, তার স্বামী জেলে মো. রুবেল হোসেনকে আটক করে কারাদন্ডাদেশ দেওয়ার পর তাদের মাছ ধরার ট্রলারটি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে ১৫হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন মৎস্য কর্মকর্তা।পরে অনেক অনুরোধ করে দশ হাজার টাকা প্রদান করেন। হুমকি দিয়ে ঘুষগ্রহণকারী মৎস্য কর্মকর্তার বিচার দাবি করেন ভুক্তভোগী নারী রহিমা বেগম।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর এই ঘুষ আদায়ের ঘটনা ঘটলেও গত ১৬ দিন স্বামী জেলে থাকায় ঘটনা প্রকাশ করেননি রহিমা বেগম।মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলম ঘুষ গ্রহণকালে রহিমা বেগমকে শাসিয়েছেন যে- “এই টাকা প্রদানের কথা কাউকে জানালে তোমার স্বামী একবছরেও জেল থেকে ছাড়া পাবেনা”।
উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না বাজার এলাকার বাসিন্দা জেলে মো.রুবেলকে গত ১০ অক্টোবর নদী থেকে ট্রলার ও জালসহ আটক করে মৎস্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে অভিযানিক টিম।পরে ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে ১৬ দিনের সাজা প্রদান করেন।শনিবার জামিন পেয়ে তিনি বাড়ী ফেরেন।এদিকে ইউএনও অফিসে সকলের উপস্থিতিতে জেলের স্ত্রীর কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায় উপজেলা থেকে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিকটও। এমনকি ভুক্তভোগী নারীর ভিডিও বক্তব্যটিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রবিবার সন্ধ্যায় অভিযোগকারী নারীকে ম্যানেজে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাসা-বাড়ী ও দলীয়কার্যালয়ে দৌঁড়ঝাপ করতে থাকেন অভিযুক্ত মৎস্য কর্মকর্তা।
স্থানীয় একটি সূত্রজানিয়েছেন- জেলের স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে ঘুষগ্রহণের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে অভিযুক্ত মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের ম্যানেজের চেষ্টা করে চলছেন।
রবিবার রাতে অভিযোগকারী নারী রহিমা বেগমকে তার বাড়ী থেকে উপজেলা সদরের এক প্রভাবশালী নেতার অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। এসময় তাকে তার অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলা হয় এবং মৎস্য কর্মকর্তা এই ঘটনার সাথে জড়িত নয়; বলে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দেওয়া হয়।
জাতীয় মৎস্যজীবী মিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিজলা উপজেলার ধুলখোলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন,মা-ইলিশ রক্ষায় বিগত যতগুলো নিষেধাজ্ঞা ছিলো তার মধ্যে সদস্য সমাপ্ত নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য দায়ী মৎস্য বিভাগ ও মাছঘাট ব্যবসায়ীরা। তারাই প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জেলেদের নদীতে নামান।তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞায় সরকার ও দেশ কিছুই পায়নি, বরং আর্থিক ও মৎস্য খাতের ক্ষতি হয়েছে। জেলেরা সরকারের বরাদ্ধের চালও পায় নদীতেও মাছ শিকার করে।আবার সরকার মৎস্য বিভাগকে অভিযান সফল করতে বিপুল অর্থ বরাদ্ধ দেন; কিন্তু কাগজে-কলমে খরচ দেখানো সেই অর্থের বিনিময়ে ইলিশ সম্পদ রক্ষা হয়নি।নদী তীরবর্তী মাছঘাট বন্ধ ও তার মালিকদের নিয়ন্ত্রন করা হলেই মূলত অভিযান সফল হবে বলে মন্তব্য তার।
ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে জানতে হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলমের সরকারি ও ব্যক্তিগত সেলফোন নাম্বারে একাধীকবার কল করলেও তিনি কোনো সারা দেননি।তবে ইউএনও’র কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়ার সময় তিনি ওই নারীকে চেনেন না এবং কোনো ধরনের টাকা নেননি বলে দাবি করে ওই নারীর সঙ্গে তর্কে জড়ান।হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইলিয়াস সিকদার তার সামনে হওয়া ঘটনাটি নিয়ে বিব্রত জানিয়ে বলেন, বিষয়টি স্থানীয় ভাবে মিমাংসার চেষ্টা করছেন উভয়পক্ষ। ভুক্তভোগী নারী সকলের সামনে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বরিশাল জেলামৎস্য কর্মকর্তা রিপনকান্তি ঘোষ বলেন, বিষয়টি স্থানীয়দের মাধ্যমে জেনেছি। সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা দিয়ে নিলামের মাধ্যমে জব্দকৃত ট্রলার নেওয়ার বিধান। ব্যক্তিগত ভাবে অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে ট্রলার ছেড়ে দেওয়াসম্পূর্ণ অবৈধ।তিনি বলেন, জেলের স্ত্রীর উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমানিত হলে দাপ্তরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; জানিয়েছে নমৎস্য বিভাগের জেলার শীর্ষ কর্মকর্তা।