মেডিকেল রিপোর্টে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও হত্যা মামলায় চার্জশিট, গলাচিপায় বিনা অপরাধে মামা-ভাগ্নের ১০ মাস ১৭ দিন কারাবাস
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:১১ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বিডি ২৪ অনলাইন নিউজ: মেডিকেল রিপোর্টে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও হত্যা মামলা দায়ের, চার্জসিট প্রদান, এলাকায় তোলপাড়। শুরু হয় ধরপাকড়, অর্থ বাণিজ্য খেলা। পূর্ব পরিকল্পিত সাজানো নাটকের গুরু ফ্যাসিস্ট দোসর রিয়াজ। সহযোগিতায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বাদী। বাদীর ঘরে ভূরিভোজের মধ্যদিয়ে সাজানো হত্যা মামলার আসামীপক্ষ এলাকা ছাড়া করেন তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা। সরেজমিন ঘুরে আসামীপক্ষ এবং এলাকাবাসী সূত্রে এসব তথ্য উঠে আসে। ঘটনাটি পটুয়াখালীর গলাচিপার উলানিয়ায় ছোট চৌদ্দকানি গ্রামের।
মামলার নথি, আসামীপক্ষের অভিযোগ এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৬ অক্টোবর-২০২৪ ইং তারিখ ঘটনাস্থল উলানিয়ায় নশু ঘড়ামির নিজ বাড়িতে সকালে দু’পক্ষের ঝগড়া-ঝাটি হয়। ঝগড়ার শেষ পর্যায়ে নিহত আমেনা বেগমের মেয়ে লাকী তার অসুস্থ মাকে বলেন তোমার ছেলের সাথে মারামারি হয় আর তুমি ঘরে বসে আছো- এই বলে টেনে হিছড়ে ঘটনাস্থলে নেন। আমেনা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে গলাচিপা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় আমেনা বেগমের সাথে স্বামী নশু ঘড়ামি হাসপাতালে গেলে বাদী এবং রিয়াজ তাকে হত্যাকারী আখ্যা দিয়ে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার দেখান। এরপরই শুরু হয় মামলা, হামলা, ঘর-বাড়ি, গাছ পালা, পুকুরের মাছ লুটপাটের ঘটনা। দুইদিন পর ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেন ০২ নং আসামি মোঃ আমিনুল ইসলাম (৪২) কে।
উল্লেখ্য, ওই মারামারির ঘটনায় দু’পক্ষের অন্য কাউকে ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে হয়নি। আর খবরের মধ্যে খবর হলো ষাটোর্ধ্ব আমেনা বেগম বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘ ৬ মাস পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। ঘটনার কিছুদিন পূর্বে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেন বলে স্বামী নশু ঘড়ামি জানিয়েছেন। কিন্তু আমেনা বেগম মারা যাওয়ার পরই স্বামী নশু ঘড়ামিসহ ০৭ জনকে আসামি করে মামলা ঢুকে দেন নিহতের ছেলে শাহিন ঘড়ামি (৩২)।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্মারক নং- পমেকহা/পটুয়া/২০২৫/৭১, তারিখ : ১৬/০৩/২৫ ইং প্রতিবেদন দেন। তাতে লাশের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ নাই। তারপরও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা বিভিন্ন তালবাহানা শেষে মামলার চার্জসিট থেকে ০৩ জন আসামিকে বাদ দিয়ে আবার ০১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করে চার্জসিট প্রদান করেন। তিনি চার্জসিটে উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন আসামীরা বাদীপক্ষের লোকজনকে দড়ি দিয়া গাছের সাথে বাঁধিয়া এলোপাথারী মারপিট করিয়া তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলা ফুলা জখম করে। ০১ আসামি বাদীর মাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে বুকে ঘুষি মারিলে বাদীর মা মাটিতে পড়ে যায়। তখন ০২ নং আসামি বাদীর মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাহার তলপেটে স্বজোড়ে লাথি মারিলে বাদীর মা ঘটনাস্থলে বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। যার আদৌ কোন সত্যতার উল্লেখ নাই মেডিকেল রিপোর্টে। জানা গেছে, তিনি মামলার ফাইনাল দিতে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। আসামীপক্ষ ৪ লাখ টাকা প্রদান করেন। তাতে খুশি হতে পারেননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
একটি হত্যা মামলার তদন্ত পাওয়া যেন সোনার হরিন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ঢাকার ওয়ারি থানায় কর্মরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনের মহানায়ক ছিলেন সোহেল রানা। ০৫ আগস্টের পর তিনি বদলী হয়ে গলাচিপা থানায় যোগদান করে আমেনা বেগম নিহতের ঘটনায় মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। চার্জসিট প্রদানের পূর্বে ২৫/০৫/২০২৫ ইং তারিখ বাদীর বাড়িতে ভূরিভোজে অংশগ্রহণ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। যা রীতিমত এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। জানা যায়, তদন্ত কর্মকর্তা এবং বাদীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক এবং আসামিপক্ষকে ভিটেবাড়ি ছাড়া করতে মরিয়া হয়ে উঠেন রিয়াজ।
কে এই রিয়াজ?
সরেজমিনে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পূর্বে রিয়াজ পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করে। সেখানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রীসহ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পরে। ০৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর রিয়াজও চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় চলে আসেন। এলাকায় এসেই তিনি ভিন্নরূপ ধারণ করেন। থানা পুলিশের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে শুরু করেন দহরাম-মহরাম।
তারই ধারাবাহিকতায় বাড়ির লোকজনকে সায়েস্তা করতে মরিয়া হয়ে উঠে রিয়াজ। তার কূটকৌশলে মোঃ নশু ঘরামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম ঘরের সন্তানদের ভাগিয়ে নেন। এবং এই মামলার মীমাংসা করে দিতে আসামীপক্ষের কাছে ৫০ লাখ টাকা এবং ৬০ শতাংশ জমি দাবি করে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রিয়াজের নেতৃত্বে নশু ঘড়ামিগংদের ৩৫টি চাম্বুল গাছ কেটে নিয়ে যায়, যার আনুমানিক মূল্য ২ লাখ ৮০ হাজার, ৮০ শতাংশ জমির ধান কেটে নিয়ে যায়, যার আনুমানিক মূল্য ৫০ হাজার টাকা এবং পুকুরের লক্ষাধিক টাকার মাছ লুটসহ নশু ঘড়ামির নির্মিত একটি টিনের ঘর দখল করে নিয়ে যায় রিয়াজ বাহিনী। যার প্রেক্ষিতে সিআর মামলা নং-৪৩৪/২৫ দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, উলানিয়া বাজারের বেকারীর দোকানদার বাচ্চু শাহ’র উত্তরা ব্যাংক গলাচিপা শাখার অ্যাকাউন্টে ৪০ লাখ টাকা আনেন রিয়াজ। এছাড়াও মুন্সিগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ির সাথে আঁতাত করে অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবসা করেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। চট্টগ্রামে বসবাসের সময় তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রীর মাধ্যমে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন বলে সূত্রের দাবি। যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ০৮ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। আসামিরা হল- ০১। মোঃ নশু ঘড়ামি (৬০), পিতা মৃত আঃ মজিদ ঘড়ামি, ০২। মোঃ আমিনুর মুন্সি (৫০), পিতা : মৃত কালু মুন্সি, ০৩। মোঃ রিপন ঘড়ামি (৩২), পিতা মোঃ নশু ঘড়ামি, ০৪। মোঃ জাহাঙ্গীর ঘড়ামি (৫৫), পিতা : মৃত চান মিয়া ঘড়ামি, ০৫। মোঃ শানু ঘড়ামি (৬৫), পিতা : মৃত আঃ মজিদ ঘড়ামি, ০৬। মোঃ আনোয়ার মুন্সি (৬০), পিতা : মৃত কালু মুন্সি, ০৭। মোঃ মাসুম ঘড়ামি (২৫), পিতা : মোঃ কালা মিয়া ঘড়ামি এবং ০৮। মোসাঃ নাজমা বেগম (৪৫), পিতা : মোঃ নশু ঘড়ামি। এছাড়াও অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামী করা হয়।
সরেজমিনে জানা গেছে, মৃত আমেনা বেগমের প্রথম স্বামী ধলা মিয়া ঘড়ামি মারা গেলে অসহায় ছেলে-মেয়েদের দেখভাল করার জন্য নশু ঘড়ামি আমেনা বেগমকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং তাদের বসবাসের জন্য একটি ঘর তুলে দেন। যা-ই কাল হয়ে দাঁড়ায় নশু ঘড়ামির জন্য।
এ ব্যাপারে মামলার ০১ আসামি বৃদ্ধ নশু ঘড়ামি মেডিকেল রিপোর্টের উপর শুনানী শেষে এ নাটকীয় মিথ্যা মামলা থেকে সব আসামির অব্যাহতি চান।