অনলাইননিউজ: অষ্টম শতকে (৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দ) উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের আমলে নির্মিত হয় দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। মসজিদটিকে বলা হয় ‘সিরিয়ার হৃদয়’।
খোলা চত্বর, পাথরের দেয়াল, সোনালি মোজাইকের কারুকাজে সজ্জিত মসজিদটি আজও সিরীয় সভ্যতার এক মহাকীর্তি হিসেবে টিকে আছে। সিরিয়ার মানুষের কাছে এটি শুধু ইবাদতখানা নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতির এক জীবন্ত সাক্ষী।
বাশার আল আসাদের দীর্ঘ সময়ের শাসনকালে মসজিদটি ছিল জরাজীর্ণ—শৌচাগারে দুর্গন্ধ, কার্পেট নোংরা, বিদ্যুৎ, পানি ও সর্বত্র ছিল অব্যবস্থা।
গত বছরের ডিসেম্বরে আসাদ শাসনের পতনের পর দেশজুড়ে মুক্তির হাওয়া বইতে শুরু করে। এ সময় ঐতিহাসিক এই নিদর্শনের করুণ অবস্থা ধরা পড়ে মানবিক সহায়তাবিষয়ক কর্মী সাদেদ্দীন মুভাকিতের চোখে পড়ে।
আলেপ্পোয় জন্ম নেওয়া সাদেদ্দীন এখন যুক্তরাষ্ট্র নিবন্ধিত এনজিও ‘হ্যান্ড’-এর ( হিউম্যান এইড এন্ড ডেভেলপমেন্ট) প্রধান নির্বাহী। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা মূলত সিরিয়া ও লেবাননের অবহেলিত মানুষদের সহায়তায় কাজ করে আসছে। আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় তারা উমাইয়া মসজিদকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনার এক বিরাট উদ্যোগ নেয়।
তিনি বলেন, মসজিদের ইমামের সঙ্গে কথা বলে জানলাম—রক্ষণাবেক্ষণের মতো লোকও নেই। তখনই ভাবলাম, এই মসজিদকে নতুন সিরিয়ার প্রতীক হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
হ্যান্ড সংস্থা গত জানুয়ারিতে দামেস্কে কাজ শুরু করে, যা রমজান শুরুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। পুরো পরিকল্পনার ব্যয় ছিল প্রায় ৩ লাখ ডলার। সংস্থাটিই এই পুরো বহনভার বহন করেছে। ৪৫ জন কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে—বিদ্যুৎ, পানি, নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অবকাঠামো— এই পাঁচটি মূল খাত উন্নত করা হয়।
এ সময় টনকে টন বর্জ্য অপসারণ, নতুন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও ১০০টির বেশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন, শৌচাগার সংস্কার, ফোয়ারা ও অজুখানায় পানি সরবরাহ, সোলার প্যানেল মেরামত, বিদ্যুৎ লাইনের জট ছাড়ানো, দেয়াল রঙ করা, জুতার র্যাক বসানো থেকে শুরু করে বাখুর আর সুগন্ধি স্প্রে দিয়ে মসজিদকে নতুন আবহ দেওয়া হয়।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মসজিদের ভেতরের নতুন কার্পেট। আগের কার্পেটগুলো কাতারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল ২০০০ সালের শুরুতে। এবার তুরস্কে তৈরি লাল রঙের উলের কার্পেট বিছানো হয়, যার অর্থায়ন করে সিরীয় সরকার। রমজানের আগেই ৩০ জন কর্মী টানা তিন রাত জেগে নতুন কার্পেট বিছান।
সাদেদ্দীনের ভাষায়, এত বছর ধরে যেন মসজিদের ইতিহাস মাটিচাপা পড়েছিল। এর মাধ্যমে শুধু মসজিদ সংস্কারের কাজ হয়নি, সিরিয়ার মানুষের কাছে তাদের ইতিহাস ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
এখনও কাজ বাকি আছে। সংস্থাটি ভবিষ্যতে মসজিদের পুরোনো শিল্পকর্ম পুনর্নির্মাণ, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন ও সোলার প্যানেল উন্নত করার পরিকল্পনা করছে। আপাতত হ্যান্ড মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছে।
মসজিদের ভেতরে বসে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে সব ধর্ম ও মতের মানুষ আসে—যেটা সত্যিই এক অপূর্ব দৃশ্য। সম্প্রতি ৭০ বছরের এক নারী আমাকে বলেছেন, তিনি ২০ বছর পর এই মসজিদে এসেছেন। এ সবকিছু মানুষকে অনুভব করিয়েছে যে মসজিদটি আসলে তাদেরই।
উমাইয়া মসজিদ সিরিয়ার মানুষের কাছে শুধু ইবাদতখানা নয়, আজও ইতিহাস, সংস্কৃতির এক জীবন্ত সাক্ষী। এই সংস্কার প্রকল্প যেন সেই সাক্ষ্যকে নতুন করে উজ্জ্বল করেছে।