হবিগঞ্জের মাধবপুরে বাণিজ্যিকভাবে তালপাখা তৈরি করে দুই শতাধিক পরিবার স্বাবলম্বী হচ্ছে। বিক্রয় হচ্ছে উপজেলা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বাণিজ্যিকভাবে তালপাখা তৈরি করছে মাধবপুর উপজেলঅর পানিহাতা, ঘিলাতলী, গাংগাইল, মেরাশানী, মনতলা, আদাঐর, শাহপুর, চৌমুহনী, ধর্মঘর সহ বিভিন্ন এলাকার গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার। তাদের আয়ের একমাত্র উর্পাজনই হচ্ছে তালপাখা তৈরি করা। বাণিজ্যিকভাবে পাখা তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে আর্থিকভাবে তারা এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী। ভীষণ গরমে জনজীবন নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে।
প্রচন্ড গরমে তালপাখার বাতাস প্রাণ জুড়ায় গ্রাম-বাংলার মানুষের। তাই তালপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাখা পল্লীর কারিগররা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাখা পল্লীর কারিগররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ পাতা কেটে সাইজ করছে, কেউ সেলাই করছে, কেউ আবার সুতা ও বাঁশের শলাতে রং করছে। কেউ বাঁধছে পাখার বোঝা। কাজের ব্যস্ততায় শরীরের ঘাম মাটিতে পড়লেও নিজেদের তৈরি পাখার বাতাস নেওয়ার সময় তাদের নেই। গরমের শুরুতে পাখা পল্লীর কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এখানকার তৈরি পাখা দেশের বিভিন্ন জেলার ও উপজেলায় যাচ্ছে। আদাঐর ইউনিয়নের পানিহাতা গ্রামের রুস্তম মিয়া জানান, তাদের পরিবার ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে পাখা তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া তাদের গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িত। ওইসব বাড়ির স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র সন্তানরা লেখাপড়ার পাশাপাশি পাখা তৈরি কাজ করেন। তার পরিবারে তিনজন (স্ত্রী, পিতা ও নিজে) পাখা তৈরির কাজ করেন। তার স্ত্রীর জানান, পাখা তৈরি করতে রং, সুতা, বাঁশ, কি , তালের পাতার প্রয়োজন হয়। একটি তালের পাতা ৫ টাকা দরে তারা কিনে থাকেন। আর যারা পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন তারা পাখা প্রতি ১ টাকা করে পান। যারা ১০০ জাড়াসোলার কাজ করে তারা ১০ টাকা পান। সব মিলিয়ে একটি পাখা তৈরি করতে ৮ টাকার বেশি খরচ হয়। তারা পাইকারী হারে পাখা বিক্রি করেন ১০ থেকে ১২ টাকায়। একজন কারিগর প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি তালপাখা তৈরি করতে পারেন। ফলে প্রতিটি কারিগর বিক্রির মৌসুমে দিনে যাবতীয় খরচ বাদে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করতে পারেন। পাইকাররা এখন বাড়ি থেকেই পাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পেশাটাকে ধরে রাখতে কাজ করছি। আমাদের গ্রামের প্রায় ১০/১২টি পরিবার তালপাখা তৈরির পেশায় রয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে বড়দের কাজে সাহায্য করতে করতে তারাও নানান নকশার পাখা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, আমার তিন ছেলে। সবাই আলাদা সংসারে পাখা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। আরেক পাখা তৈরির কারিগর মোঃ মুরসালিন জানান, তাদের পুঁজি কম। তাই অল্প পুঁজি নিয়ে এ পেশা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সরকার যদি পাখা কারিগরদের বিনামূল্যে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে এ শিল্পকে ধরা রাখা যেতো।
কারিগর আক্কাছ মিয়া বলেন, এ বছরের গ্রীষ্মের শুরু থেকে দিনের বেলায় প্রচন্ড তাপদাহ আর রাতের ভ্যাপসা গরমে পাখার ব্যাপক চাহিদা। গ্রামের সব বাড়িতেই পাখা তৈরি করা হয়। ফলে গ্রামটি তালপাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ পাখা পল্লী থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে আশপাশের অনেক জেলার পাইকাররা এসে নগদ টাকায় কিনে নেন। পূর্ব পুরুষদের পেশাটাকে ধরে রাখার জন্য এখনও তারা পাখা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।
মাধবপুর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়া জানান, হাত পাখার তৈরির প্রধান উপকরণ তালপাতা সব সময় পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমে চারা গাছের পাতা কিনে আনেন তারা। তারপর পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। পরে পানি থেকে উঠিয়ে নরম ভেজা পাতা গোলাকার করে কেটে মাঝখান থেকে বের করেন। এরপর বোঝা বেঁধে পাতা ঘরে রেখে দেন। পরে আবার তা পানিতে ভিজিয়ে ২৪ ঘণ্টা রাখেন এবং সেখান থেকে নিয়ে সারাবছর বাড়ীতে বসে তালপাখা তৈরী করেন। একটি তাল পাতা থেকে দুটি তালপাখা তৈরি হয়। কারিগর মুর্শিদ মিয়া বলেন, বছরের চৈত্র, বেশাখ, জ্যৈষ্ঠ এ তিন মাস পাখা বিক্রির মৌসুম ধরা হয়। আবহাওয়া ঠান্ডা হলে অথবা শীত আসলে বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিন মাসের রোজগারের পয়সায় সারা বছর চলতে হয়।
সুরেন্দ্র সরকার নামের একজন কারিগর জানান, গত বছরগুলোর চেয়ে এবছর একটি পাখাতে দাম বেড়েছে প্রায় ৩ থেকে ৪ টাকা। কিন্তু লাভ হচ্ছে কম। কারণ প্রতিটি জিনিসেরই দাম বেশি। তিনি আরও জানান, প্রতিটি পাখায় তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৮ থেকে ১০ টাকা খরচ হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১২ থেকে ১৫ টাকা টাকা। অবশ্য পাইকাররা একটি পাখা ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করে। অবশ্য খুব গরমের মধ্যে হাত পাখার চাহিদা বেশি হওয়ায় সে সময় একটি পাখা তারা ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি করে। মাধবপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, উপজেলার অধিকাংশ লোকই গরিব। বছরের তিন মাস পাখা বিক্রির সুযোগ পান। বাকি সময়টা তাদের অভাবে দিন কাটে। ফলে তারা অল্প সুদে ঋণ পাওয়ার যোগ্য। মাধবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন হাসান বলেন, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস বিভিন্ন ভাবে লোন দিয়ে থাকে। যদি পাখা বানানোর কারিগররা উপজেলা যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নেয় তাহলে তারা সেখানে থেকে লোন নিতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমি তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন এবং তিনি আরো বলেন, যদি প্রত্যেকটি পরিবারে ১টি করে তাল গাছ রোপন করে তাহলে ১ বছর পর থেকেই পাতা দিয়ে তাল পাখা বানানোর উপযুক্ত হয়ে যায় এমনকি তাল গাছ বজ্রপাত নিরোধক একটি গাছ। এ গাছ বাড়িতে থাকলে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।