
বিডি ২৪ অনলাইন নিউজ: গণপূর্ত অধিদপ্তরের সিঞ্চিত মাঠ, প্রকল্প বরাদ্দের কক্ষ এবং অফিস কক্ষের ভেতরে অব্যাহত কমিশন বাণিজ্য ও অনিয়মের ছবি একধরনের অদৃশ্য শিল্পকর্মের মতো। ঢাকার বিজ্ঞ সিএমএম আদালতে দায়ের হওয়া সিআর মামলা নং-১১৮/২০২৫ অনুসারে (ধারা: ১৪৭/১৪৮/৩২৬/৩০৭/৫০৬/৩৪), গণঅভূত্থানের মামলার আসামী শামসুদ্দোহা, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা জোন, এখনও বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। এই মামলায় ২৫ জনেরও বেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা জোনের গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকল্প বরাদ্দ কার্যক্রমের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কার্যরত রয়েছে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটটি শুধুমাত্র ঠিকাদার চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রকৌশলীদের মাঠ পর্যায়ের অনুমোদন, বিল পাস এবং অফিস পর্যায়ের কার্য সম্পন্নকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
উচ্চ পর্যায়ের কমিশন (৫-৭%): টেন্ডার অনুমোদনের আগে সিন্ডিকেটের সিনিয়র সদস্যদের জন্য।
ফিল্ড পর্যায়ের কমিশন (৩-৫%): প্রকৌশলীদের মাঠ পর্যায়ের অনুমোদন ও বিল পাসের বিনিময়ে।
রাজনৈতিক কমিশন (৩-৫%): সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মধ্যস্থদের জন্য।
অফিস কমিশন (২-৩%): বিল রেকর্ড ও কন্ট্রোল শাখায় কার্য সম্পন্নের বিনিময়ে।
এই কমিশন বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা জোনের ইলেকট্রিক্যাল/মেকানিক্যাল ও সিভিল বিভাগ। অফিসের বিভিন্ন পর্যায়ে বহু কর্মকর্তা অবসরের পরও প্রভাব ধরে রেখেছেন।
সিএমএম আদালতে দায়ের হওয়া মামলা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর অগ্রগতি নেই। তদন্তকারীরা বলছেন, মামলা চললেও অফিসিয়াল পদ্ধতিতে সিন্ডিকেটের হাতে থাকা শক্তি এবং রাজনৈতিক প্রভাব মামলা পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, শামসুদ্দোহা সহ প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রকল্প বরাদ্দ ও টেন্ডার অনুমোদন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছেন। এই অবস্থায় তৃতীয় পক্ষের স্বচ্ছ তদন্ত ছাড়া মামলার কার্যক্রম আটকে আছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে প্রকৌশলীরা বিভিন্ন ধরণের কমিশন বাণিজ্যের সাথে যুক্ত। টেন্ডার অনুমোদন থেকে প্রকল্প সম্পন্নকরণ পর্যন্ত পর্যায়ের কার্যক্রমে অবৈধ কমিশন চক্র দৃশ্যমান। ঠিকাদারদেরও এসব চক্রের সঙ্গে সমঝোতা থাকতে হয়, যার মাধ্যমে প্রকল্প বরাদ্দ, বিল পাস এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
একাধিক প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার জানিয়েছেন, “কোনো প্রকল্পের বিল পাসের আগে আমাদের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু সম্ভব নয়। অনেক সময় অফিসি পর্যায়ের অনুমোদন পেতে আমাদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।”
কমিশন বাণিজ্যের আরেকটি দিক হলো রাজনৈতিক সমঝোতা। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রকল্প বরাদ্দ এবং ঠিকাদার চক্রের নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই কৌশলটি শুধু অর্থনৈতিক দিকের জন্য নয়, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে।
একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, “প্রকল্প বরাদ্দের সময় রাজনৈতিক কমিশন ফি আদায় করা হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা এবং মধ্যস্থরা তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করে। এটি একটি সুপরিকল্পিত বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত হলেও, তাদের প্রভাব এখনও কার্যকর। তারা প্রকল্প বরাদ্দ ও টেন্ডার অনুমোদনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমঝোতা বজায় রাখেন। এই প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক প্রমাণ করে যে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শুধু নাম অবসরের পরে, অফিসের সিদ্ধান্তে সক্রিয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন।
ঢাকার গণপূর্ত অধিদপ্তরে সিন্ডিকেটের কার্যক্রম এক অদৃশ্য কারখানার মতো। এখানে ঠিকাদার চক্র, প্রকৌশলী এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধি একত্রিত হয়ে অবৈধ কমিশন সংগ্রহ ও প্রকল্প বরাদ্দ প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করেন।
ঠিকাদার চক্র: প্রকল্প বরাদ্দ ও কার্যাদেশ প্রাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা: মাঠ পর্যায়ের অনুমোদন ও বিল পাসে নিয়ন্ত্রণ।
রাজনৈতিক প্রতিনিধি: সুপারিশ ও কমিশন আদায়।
এই তিনটি স্তর মিলিত হয়ে একটি কার্যকরী “অদৃশ্য কারখানা” গড়ে তুলেছে, যা প্রকল্প বরাদ্দ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে।
গণপূর্তের এই চক্রটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও প্রশাসনিক দিক থেকেও বিপজ্জনক। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্পের মান হ্রাস পাচ্ছে, জনগণের টাকা অপচয় হচ্ছে এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে পুরো প্রতিষ্ঠান কার্যকর হচ্ছে না।
সরাসরি সাক্ষাৎকারে এক সিভিল প্রকৌশলী বলেন, “প্রকল্প বরাদ্দে স্বচ্ছতা নেই। কমিশন বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রকল্প সম্পাদনের মান অনুযায়ী সম্পন্ন হচ্ছে না।
এটি নাগরিকদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ।”
সিএমএম আদালতে মামলা নথিভুক্ত হলেও কার্যকর অগ্রগতি না থাকায় বিশ্লেষকরা সতর্ক। তাদের মতে, শামসুদ্দোহা ও অন্যান্য অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ, তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন তদন্ত ছাড়া কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
একজন প্রশাসনিক বিশ্লেষক বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত স্বচ্ছ তদন্ত এবং আদালতের কার্যকর পর্যবেক্ষণ নেই, ততক্ষণ সিন্ডিকেট কার্যক্রম থেমে থাকবে না। এটি গণপূর্তের ভবিষ্যত ও দেশের প্রকৌশল মানের জন্য বিপজ্জনক।”
ঢাকার গণপূর্ত অধিদপ্তরে সিন্ডিকেটের দখল, কমিশন বাণিজ্য, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রকৌশলীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, অবসরের পরও শামসুদ্দোহা ও অন্যান্য প্রভাবশালী কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন।
দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রোগ্রামের জন্য এটি এক ভয়াবহ বাস্তবতা।
এই চক্র ভাঙতে হলে প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত, স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার বাস্তবায়ন।
নাগরিক এবং গণমাধ্যমের নজরদারি ছাড়া গণপূর্তে প্রকল্প বরাদ্দ ও কমিশন বাণিজ্যের এই অদৃশ্য কারখানা কার্যকরভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে না।