
বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন:বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনসেবা প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর আজ এক ভয়াবহ দুর্নীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই প্রতিষ্ঠানের কুমিল্লা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ-এর বিরুদ্ধে উঠেছে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার, টেন্ডার জালিয়াতি, শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, ঘুষ গ্রহণ, এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ। অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, নাসরুল্লাহ তার পদমর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতির নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঘরে পর্যন্ত। কীভাবে একজন সরকারি প্রকৌশলী রাষ্ট্রের অর্থকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছেন, আবার সেই অর্থ পাচার করে কানাডার মতো দেশে স্থায়ী সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক
আশ্রয়ে উত্থান :
মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা, যার পদ নবম গ্রেডের হলেও সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তিনি পঞ্চম গ্রেডের নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে উন্নীত হন। প্রশাসনিক নিয়ম ভেঙে এই অস্বাভাবিক পদোন্নতি কেবল তার জন্যই নয়, বরং পুরো অধিদপ্তরের মধ্যে একটি দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি করে দেয়। বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহচর মো. কামাল হোসেন (বর্তমানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ মামলায় অভিযুক্ত ও পলাতক) ছিলেন এই নেটওয়ার্কের মূল সমন্বয়ক। কামালের সহযোগিতায় নাসরুল্লাহ ডিপিএইচই-কে পরিণত করেন ‘বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডার বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে’।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পাহাড় :
দুদকের নথি ও একাধিক সাংবাদিক সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, নাসরুল্লাহর বৈধ আয় মাত্র ২০ লক্ষ টাকা, অথচ তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক ফ্ল্যাট; চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় একটি পাঁচতলা বিলাসবহুল ভবন; পূর্বাচলে প্রায় ১০ কোটি টাকার প্লট; কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে তার বড় ভাই শহিদুল্লাহর নামে ৫০ একর বেনামি জমি; দুটি প্রিমিও গাড়ি (একটি ঢাকা মেট্রো-গ-২০-৮৫১৩) এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নাসরুল্লাহ তার অবৈধ আয় থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কানাডায় পাচার করে সেখানে বাড়ি ও ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। এগুলো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ নং ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিযোগ
অনুযায়ী, নাসরুল্লাহ শুধুমাত্র ঘুষ নিতেন না; তিনি সেটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিণত করেছিলেন। তার স্ত্রী, শাশুড়ি, দুই শ্যালক ও বড় ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে অর্থ পাচার করা হতো। একটি দালিলিক নথিতে দেখা যায়, একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের হিসাবে।
২৬ জুন ২০২০ ইং তারিখে মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশন থেকে মোহাম্মদ নাসরুল্লাহর প্রিমিয়ার ব্যাংক, কুমিল্লা ১২,০৩,০০০ টাকা
২৪ মার্চ ২০২২ ইং তারিখে মেসার্স শম্পা এন্টারপ্রাইজ থেকে তার শাশুড়ি মোসা. রেহানা আক্তারের ইউনিয়ন ব্যাংক, আগ্রাবাদ শাখায় ৩২,৫০,০০০ টাকা
১৯ মে ২০২২ ইং তারিখে মেসার্স শামীম ট্রেডার্স থেকে তার স্ত্রী মোসা. সানজিদা চৌধুরীর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, জুবলি রোড শাখায় ২,৫০,০০০ টাকা।
১৯ মে ২০২২ ইং তারিখে মেসার্স শামীম ট্রেডার্স তার শ্যালক মো. শাহিনুর চৌধুরী ব্যাংক এশিয়া, চাক্তাই শাখায় ৫০,০০,০০০ টাকা।
১৭ অক্টোবর ২০২২ইং তারিখে মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশন থেকে তার বড় ভাই মো. শহিদুল্লাহর ন্যাশনাল ব্যাংক, বরুড়া শাখায় ১২,০০,০০০ টাকা আসে
বিশ্লেষকরা বলছেন, “একই দিনে একই ঠিকাদার থেকে দুই শ্যালকের হিসাবে এক কোটি টাকা জমা হওয়া কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়, বরং এটি ‘পেমেন্ট ফর প্রোটেকশন’ অর্থাৎ ঘুষের ডিজিটাল ছদ্মবেশ।” জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজের সবচেয়ে বড় অংশ হলো পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প। কিন্তু নাসরুল্লাহ এই জনকল্যাণমূলক খাতকেই পরিণত করেছেন নিজের অর্থ সংগ্রহের উৎসে।
২০২১-২২ অর্থবছরের পল্লী পানি সরবরাহ প্রকল্পে (ঞবহফবৎ ওউ: ৭০৮৬৪২) তিনি কোনো কাজ না করেই মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনকে বিল প্রদান করেন। এটি দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৯ ধারায় সরকারি কর্মচারীর ফৌজদারি বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ।
পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে “নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প”-এর ৩১টি প্যাকেজের মধ্যে ২৫টি মেসার্স কামাল এন্টারপ্রাইজকে পাইয়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, নাসরুল্লাহ আগেই অফিসিয়াল প্রাক্কলন ফাঁস করে দেন যাতে কামালের প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে কম দর দিয়ে টেন্ডার পায়। এরপর এসব কাজ ৪% কমিশনে অন্য ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করা হয়— অর্থাৎ কাজ না করেও কমিশন খেয়ে বসে থাকা এক ধরনের প্রকল্প সিন্ডিকেট। এই কর্যক্রমের মাধ্যমে প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “নাসরুল্লাহ অফিসে এমন পরিবেশ তৈরি করেছেন, যেখানে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল সামনে এগোয় না।” যে কোনো কাজের জন্য নির্দিষ্ট রেট নির্ধারিত ছিল- পাম্প স্থাপন প্রকল্পে বিল ছাড় করতে ২% কমিশন, টেন্ডার অনুমোদনে ৩-৫% ঘুষ, বদলির জন্য ৫০,০০০ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত
একজন কর্মচারী বলেন, “তিনি এমনভাবে সিস্টেম তৈরি করেছিলেন, যেন কেউ ঘুষ না দিলে প্রশাসনিক ফাইল আটকে থাকে। মন্ত্রী বা সচিব পর্যন্ত বিষয়টি জানতেন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কেউ মুখ খোলেনি।” দুদকের কাছে জমা দেওয়া একাধিক ব্যাংক নথি ও প্রবাসী তথ্য অনুযায়ী, নাসরুল্লাহ কানাডার টরন্টো শহরে একটি বাড়ি ক্রয় করেছেন এবং সেখানকার ব্যাংকে কয়েক লাখ কানাডিয়ান ডলার জমা রেখেছেন। এই টাকা বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি ও ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে পাচার করা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ আছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী, বিদেশে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর একটি “চৎবফরপধঃব ঙভভবহপব”, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছর কারাদণ্ড।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মোহাম্মদ নাসরুল্লাহর কর্মকাণ্ড নিম্নলিখিত আইনসমূহের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন:
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭- ধারা ৫(২): সরকারি কর্মচারী হিসেবে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪- ধারা ২৬ ও ২৭: জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও গোপন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২- ধারা ৪: অবৈধ অর্থ স্থানান্তর ও উৎস গোপন। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-ধারা ৪০৯: সরকারি তহবিল আত্মসাৎ। আইনজীবীরা বলছেন, এই অভিযোগগুলোর প্রতিটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং প্রতিটির জন্য সর্বোচ্চ সাজা জরিমানা ও দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড।অভিযোগকারী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এক আইনজীবী এই ঘটনার বিষয়ে দুদকের সচিবের কাছে দাখিল করা আবেদনে বলেন- “এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়ংকর ক্যান্সার। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অন্য দুর্নীতিবাজরা আরও উৎসাহিত হবে। দুদকের নীরবতা জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করবে।”জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একদল কর্মকর্তা মিলে এটিকে ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের যন্ত্রে পরিণত করেছে বলে প্রশাসনের ভেতরের একাধিক সূত্র দাবি করছে।
দুদকের এক সাবেক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ডিপিএইচই এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে ঘুষের লেনদেন চলে। এ ধরনের সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে একজন নাসরুল্লাহ নয়, পুরো নেটওয়ার্ককে ভাঙতে হবে।”কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঠিকাদার, স্থানীয় সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিকরা দুদকের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
এক ঠিকাদার বলেন, “আমরা সৎভাবে কাজ করতে চাই, কিন্তু এই ধরনের কর্মকর্তাদের কারণে আমাদের ব্যবসা ও সুনাম ধ্বংস হচ্ছে। ঘুষ না দিলে কাজ পাওয়া যায় না।” অন্যদিকে স্থানীয় নাগরিকদের একাংশ বলছেন, “যে অর্থ জনগণের পানি সরবরাহে ব্যয় হওয়ার কথা, সেই অর্থ দিয়ে কেউ কানাডায় বাড়ি বানায় — এটা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।” জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই ঘটনা কেবল একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রকাশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাসরুল্লাহর মতো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। দুদক যদি দ্রুত তদন্ত শুরু করে প্রমাণ সংগ্রহ করে বিচার নিশ্চিত করতে পারে, তবে এটি দেশের অ্যান্টি-করাপশন মুভমেন্টে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের এই কাহিনী প্রমাণ করে— রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা একত্রে মিলে কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির মহাসাগরে ডুবিয়ে দিতে পারে। দুদকের দায়িত্ব এখন এই দুর্নীতির পাহাড় খনন করে সত্য উন্মোচন করা, যাতে জনগণের টাকায় গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো আবার জনগণের জন্যই কাজ করে।