ডিম কমবেশি সবারই প্রিয়। ডিমের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা অনেক বেশি। তাইতো ডিমকে প্রোটিন ও পুষ্টি উপাদানের পাওয়ার হাউস বলা হয়। ডিমের এসব উপকারিতা ভেবে ডিম খান। আবার অনেকে ডিম নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা নিজের মধ্যে পোষণ করে ডিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ তারা ভ্রান্ত ধারণাকেই সত্যি বলে জানেন। আসুন জেনে নিই ডিম নিয়ে এমনই কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণা-
১. ডিমে কোলেস্টেরল বেশি
অনেকেই নিশ্চয়ই শুনেছেন ডিম খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই ডিম যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। এমনকি যাদের এমনিতেই রক্তে কোলেস্টেরল রয়েছে তারা ডিম খাওয়াই বাদ দিয়ে দেন। এটি কিন্তু একেবারেই ভুল। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম আসলে আমাদের রক্তের কোলেস্টেরল স্তরে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। বরং নিয়মিত ডিম খাওয়া নিরাপদ, এমনকি যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্যও। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ার মূল কারণ হলো ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট (চর্বি) এবং অতিরিক্ত চিনি। যদিও একটি ডিমে প্রায় ২১১ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে, যা দৈনিক প্রস্তাবিত পরিমাণের প্রায় ৭০ শতাংশ, যা স্বাস্থ্যের জন্য কোনো বড় হুমকি নয়। হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য এমন খাদ্যাভ্যাসে থাকা উচিত, যেখানে ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকে।
২. বাদামি ও সাদা ডিমের পুষ্টিগুণে পার্থক্য
আমরা অনেকেই মনে করি, বাদামি রঙের খাবার মানেই স্বাস্থ্যকর। যেমন-লাল আটা, ব্রাউন রাইস বা গমের পাস্তা বেশি স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এই ধারণা ডিমের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সাদা ডিম ও বাদামি ডিমের পুষ্টিমান ও স্বাস্থ্য উপকারিতা মূলত একই। তবে বাদামি ডিমের দাম সাধারণত সাদা ডিমের চেয়ে কিছুটা বেশি হয়। এর কারণ ডিমের মান নয়, বরং বাদামি ডিম পাড়া মুরগিগুলো সাধারণত বড় ও বেশি খাবার খায়, ফলে তাদের লালনপালন খরচ বেশি পড়ে। তাই ডিমের রং দেখে নয়, নিজের পছন্দ ও বাজেট অনুযায়ী যে কোনো ডিম কিনলেই হবে, পুষ্টিগত দিক থেকে দুটিই সমান।
৩. বাদামি ডিম আসে বাদামি রঙের মুরগি থেকে
অনেকেই মনে করেন, বাদামি ডিম মানে সেই মুরগির পালকও বাদামি। কিন্তু বাস্তবে এমন নয়। ডিমের রং নির্ভর করে মুরগির কানপল্লবের রঙের ওপর, পালকের রঙের ওপর নয়। সাধারণত লাল কানপল্লবযুক্ত মুরগি বাদামি ডিম পাড়ে, আর সাদা কানপল্লবযুক্ত মুরগি সাদা ডিম পাড়ে। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু এই নিয়ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য।
৪. গর্ভবতী নারীদের ডিম খাওয়া উচিত নয়
অনেক গর্ভবতী নারী মনে করেন যে ডিম খেলে শিশুর ডিমে অ্যালার্জি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এই ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই। বাস্তবে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা গর্ভাবস্থায় ডিম খাওয়ার পরামর্শই দিয়ে থাকেন। ডিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মা ও শিশুর উভয়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গর্ভাবস্থায় এই পুষ্টিগুলো শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও মায়ের শক্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত কাঁচা বা আধা সিদ্ধ ডিম কখনোই খাওয়া উচিত নয়, কারণ এতে সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকি থাকে। এই সতর্কতা শুধু গর্ভবতী নারীদের জন্য নয়, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সিদ্ধ ডিম গর্ভবতী নারীর জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য, যা মা ও শিশুর সুস্থতা রক্ষায় সহায়তা করে।
৫. মুরগির ডিম কেবল সাদা বা বাদামি হয়
অনেকে ভাবেন, মুরগির ডিম মানেই শুধু সাদা বা বাদামি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ডিম আরও বিভিন্ন রঙের হতে পারে। যেমন-আরকনা জাতের মুরগি নীল বা সবুজ রঙের ডিম পাড়তে পারে। ডিমের খোসার রং নির্ভর করে একটি প্রাকৃতিক রঞ্জক পদার্থের ওপর, যার নাম প্রোটোপর্ফিরিন। এই রঞ্জক পদার্থের পরিমাণ ও প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ডিমের খোসা কখনো বাদামি, কখনো নীল, আবার কখনো সবুজও হতে পারে। অর্থাৎ ডিমের রং যেমনি হোক, তার পুষ্টিগুণ সব ক্ষেত্রেই প্রায় একই।
৬. প্রতিদিন ডিম খাওয়া ক্ষতিকর
অনেকে ভাবেন, প্রতিদিন ডিম খেলে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে, প্রতিদিন একটি ডিম খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ, যদি আপনার খাদ্যাভ্যাসে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাবার যেমন ফল, সবজি, মাংস, ডাল, বাদাম ও বীজ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। ডিমে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা স্বাস্থ্যকর জীবনধারার জন্য উপকারী। প্রতিদিন ডিম খাওয়া কেবল আপনার পুষ্টি বজায় রাখে না, বরং স্বাদ ও বাজেটের দিক থেকেও সুবিধাজনক।
৭. কাঁচা ডিমে পুষ্টি বেশি
অনেকে মনে করেন, কাঁচা ডিম খেলে শরীরে দ্রুত পেশি গঠন হয়, কারণ তাতে নাকি বেশি প্রোটিন থাকে। সিনেমায় দেখা যায়, বডি বিল্ডাররা সকালে এক গ্লাস দুধের সঙ্গে কাঁচা ডিম গিলে নিচ্ছে-দৃশ্যটা আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবতা একদম আলাদা। বাস্তবে এই ধারণার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, বরং এটি অতিরঞ্জিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ শরীর কাঁচা ডিমের সাদা অংশ ভালোভাবে হজম করতে পারে না। এমনকি কাঁচা ডিমে থাকা বায়োটিন (ভিটামিন বি৭) শোষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে রান্না করা ডিম শুধু সহজে হজমযোগ্যই নয়, সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকিও প্রায় সম্পূর্ণ দূর করে দেয়। অতএব পুষ্টি ও নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে, রান্না করা ডিমই সর্বাধিক উপকারী ও নিরাপদ খাদ্য।