শুক্রবার ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   শুক্রবার ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)
বদলি-বাণিজ্য, ঘুষ নিয়ন্ত্রণ করতেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, ছয় বছরের সাম্রাজ্য শাহজাহান আলীর
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর, ২০২৫, ৩:২০ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

বদলি-বাণিজ্য, ঘুষ নিয়ন্ত্রণ করতেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, ছয় বছরের সাম্রাজ্য শাহজাহান আলীর

বিডি ২৪ নিউজ অনলাইন: শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)-দেশব্যাপী স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ, সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর। এখানে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু সেই দপ্তর দীর্ঘদিন ধরে এক ব্যক্তির প্রভাব, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, বদলি-বাণিজ্য ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত হয়ে আছে। সেই একক ব্যক্তির নাম-শাহজাহান আলী, নির্বাহী প্রকৌশলী (ডেস্ক১) ও ইইডির সাবেক ক্যাশিয়ার। দপ্তরের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং একাধিক সূত্রের ভাষ্যশাহজাহান আলী শুধু একজন কর্মকর্তা নন; তিনি ছিলেন এক অঘোষিত কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যিনি বদলি, পদায়ন, টেন্ডার, বিল পাস-সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।

মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা ও লবি নিয়ন্ত্রণ : শাহজাহান আলীকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই দাপটের অন্যতম মূল শক্তি ছিল-সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবের পরিচিতি। এই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে তিনি ইইডি জুড়ে শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। সেই নেটওয়ার্কে ছিলেন কিছু নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, কয়েকজন ঠিকাদার এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট লবির কিছু ব্যক্তি।দপ্তরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “ইইডিতে গত কয়েক বছরে কোন কর্মকর্তা কোথায় যাবেন-এটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অনেক সময় প্রধান প্রকৌশলীরও ছিল না। শাহজাহান আলী যদি না চান, বদলি বাস্তবায়নই হতো না।

চারজন প্রধান প্রকৌশলীও তার প্রভাবে ছিলেন “বাধ্য” অভিযোগ রয়েছে, ইইডির সর্বশেষ চারজন প্রধান প্রকৌশলীই শাহজাহান আলীর চাপ-প্রভাবের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি। কোনো সিদ্ধান্ত তার মনপসন্দ না হলে সেই প্রধান প্রকৌশলীর বদলি পর্যন্ত নিশ্চিত করা হতো বলে অভিযোগ উঠেছে। সদ্য জারি হওয়া তিন নির্বাহী প্রকৌশলীর বদলি আদেশও বাস্তবায়ন হয়নি শুধুমাত্র শাহজাহান আলীর ‘ইঙ্গিত’ না পাওয়ায়। এর ফলে মেহেরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী একমাস ধরে যশোরে যোগদান করতে পারছেন না-প্রশাসনিকভাবে এমন অবস্থাকে বলা হচ্ছে “ভাসমান পদায়ন”।
এক কর্মকর্তা বলেন, “বদলি আদেশ কখন কার্যকর হবে, কার নাম তালিকায় উঠবে-এসব সিদ্ধান্ত শাহজাহানের অনুমতি ছাড়া সম্ভব হতো না।” সূত্র বলছে-অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে দশজন নির্বাহী প্রকৌশলীর পদায়নের বিশেষ তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যেখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ নেই।
কুড়িগ্রামে ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহতার কেন্দ্রেই ছিলেন তিনি : শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠে আসে কুড়িগ্রামে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের। একাধিক অভিযোগ, সাক্ষ্য ও নথিতে উঠে এসেছে ঘুষ-দুর্নীতির সংগঠিত পদ্ধতির একটি ভয়াবহ চিত্র-
১. ঠিকাদারের বিল পাসের আগে ৫% বাধ্যতামূলক ঘুষ : যে ঠিকাদারি কাজই হোক-শেষ বিল পাসের আগে ঠিকাদারকে ৫% ঘুষ দিতে হতো। অন্যথায় বিল মাসের পর মাস আটকে রাখা হতো।
২. উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের থেকে ১% ‘এলাকা ঘুষ’ : উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের কাজের এলাকা বণ্টন করা হতো সরাসরি অর্থের বিনিময়ে। এর হার ছিল-১% “এলাকা কমিশন”।
৩. টেন্ডার কিনে রাখা এবং কমিশনে বিক্রি : কিছু ‘ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার’ ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানির নামে দরপত্র কিনে রাখা হতো। পরে তা ৫% কমিশনের বিনিময়ে অন্য ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করা হতো।
৪. ৩৯টির মধ্যে ২৬টি দরপত্র এক ঠিকাদারকে দেওয়া : আসবাবপত্র সরবরাহ প্রকল্পে আহ্বান করা ৩৯টি দরপত্রের ২৬টি দেওয়া হয় তারই পছন্দের ঠিকাদারকে। এমন অনিয়ম টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার বৈধতার ওপর বড় প্রশ্ন তোলে। স্থানীয় অনেক ঠিকাদার জানান-সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কাজ করতে চাইলে তাকে ভয়ভীতি, হুমকি বা হয়রানির শিকার হতে হতো।
এক ঠিকাদার বলেন- “দরপত্র দিতে গেলে আগেই বলা থাকত-এটা ‘শাহজাহানের টেন্ডার’। ওখানে অন্য কেউ অংশ নিলে বিপদ রয়েছে।” ইইডির কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন-হিসাবরক্ষক ও অফিস সহকারীদের মাধ্যমে নিয়মিত ঘুষ তোলা হতো। এই অর্থ সরাসরি উপরের স্তরে যেত সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে। সৎ এবং ঘুষবিরোধী উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো। তাদের বদলি শুধু অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে।
এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন- “দপ্তরে কার কী দায়িত্ব হবে-এটা দক্ষতা দেখে নয়, ঘুষের পরিমাণ দেখে ঠিক হতো।” অনিয়মের টাকায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে বড় আকারে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে-
রংপুরে ক্লিনিক ব্যবসা স্থাপন : ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট ক্রয়, গ্রামের বাড়িতে বিস্তর জমি কেনা
একাধিক কর্মকর্তা বলেন- “একজন সরকারি কর্মকর্তার বৈধ আয়ে এ ধরনের সম্পদ সংগ্রহ অসম্ভব। এটা সহজেই অনুমেয়-টাকা এসেছে ‘সিস্টেম’ থেকে।” অভিযোগ প্রকাশ্যে আসা শুরু করতেই তিনি দ্রুত টাঙ্গাইল জেলায় বদলি নিয়ে নিজের অবস্থান আড়াল করেন।
বহুবার চেষ্টা করেও শাহজাহান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার ও সহকর্মীরাও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি- এ মামলা প্রকাশ্যে এলে অনেকেই বিপদে পড়তে পারেন, তাই কেউই নাম প্রকাশের ভয় পাচ্ছেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলনে“অনিয়মে পার পাওয়া যাবে না” রংপুর বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারেক আনোয়ার জাহেদী বলেন- “যদি কেউ অনিয়ম করে থাকে, সে যত বড় প্রভাবশালীই হোক, পার পাওয়া যাবে না। দশ বছর পর হলেও সত্য বেরিয়ে আসে।” তিনি সকল অভিযোগ তদন্ত করার আশ্বাস দিয়েছেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে দুর্নীতি নতুন নয়, তবে শাহজাহান আলীর সময় এই অনিয়মকে বলা হচ্ছে- “কেন্দ্রীয়কৃত দুর্নীতি মডেল”। তার নেতৃত্বেই- বদলি-বাণিজ্য পদায়ন সিন্ডিকেট ঘুষ সংগ্রহ টেন্ডার-জালিয়াতি ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ এসব প্রক্রিয়া আরও সংগঠিত হয়েছিল বলে অভিযোগ। এক কর্মকর্তা বলেন- “একসময় টেবিল থেকে ঘুষ নেওয়া হতো। এখন ফাইল ওঠার আগেই ঘুষ নির্ধারিত থাকে। এটা শাহজাহানের তৈরি করা মডেল।”
‘সিন্ডিকেট ভেঙে তদন্ত হোক’ : দপ্তরের অভ্যন্তরে অনেকেই বলছেন, সিন্ডিকেটকে ভেঙে দিতে হবে। অন্যথায় বদলি-বাণিজ্য, ঘুষ ও টেন্ডার জালিয়াতি বন্ধ হবে না। তাদের বক্তব্য- “একজনের দাপটে পুরো দপ্তরকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। তদন্ত না হলে সরকারি অর্থের ক্ষতি বন্ধ হবে না।”
শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা শুধু বেশি নয়-ভয়াবহ। তিনি বদলি-বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন, টেন্ডার সিন্ডিকেট নিয়ম করেছেন, ঘুষ বাধ্যতামূলক করেছেন, সৎ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করেছেন, ঠিকাদারদের জিম্মি করেছেন এবং নিজের প্রভাব রক্ষায় মন্ত্রণালয়ের লবি ব্যবহার করেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন দাপট কেবল দপ্তরের প্রশাসনিক কাঠামোকেই দুর্বল করে না-ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের শিক্ষা অবকাঠামো।শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে- “দপ্তরকে ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই নিরপেক্ষ তদন্ত, সম্পদ যাচাই এবং সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার বিকল্প নেই।




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক ও সিইও: মামুনুর রশীদ নোমানী

ইমেইল: nomanibsl@gmail.com

মোবাইল: 01713799669 / 01712596354

 

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।

© বিডি ২৪ নিউজ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  বদলি-বাণিজ্য, ঘুষ নিয়ন্ত্রণ করতেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, ছয় বছরের সাম্রাজ্য শাহজাহান আলীর   বরিশালে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জায়গা দখল চেষ্টার অভিযোগ   বরিশালে বিসিক উদ্যোক্তা মেলায় স্টল বরাদ্দে অনিয়ম   বরিশাল কর অফিসের রতন মোল্লার হাতে আলাদিনের চেরাগ,একই কর্মস্থলে ১০ বছর   বরিশালের ১৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা   বরিশালে অপসাংবাদিকতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ ৩৫ সংগঠন   আটকে আছে ১৭শ কিলোমিটার সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন কাজ   বরিশালের রাঙামাটি নদী থেকে হাত-পা বাঁধা যুবকের লাশ উদ্ধার   সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে লাপাত্তা ডিআইজি এহসানউল্লাহ   বরিশালের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা ঘুস নিয়ে বদলীর অভিযোগ   বরিশালে ফরচুন মিজানের ভাই রবিউল আটক   দালাইলামা মডেলে হাসিনাকে নিয়ে নানা পরিকল্পনা দিল্লির   শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর বরিশালে বাস্তবায়ন করছে ৭শ’ কোটি টাকার প্রকল্প   বরিশালের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বদলী বাণিজ্যের অভিযোগ   চলন্ত বিআরটিসি বাসে অগ্নিকাণ্ড,সব যাত্রী নিরাপদে   কাজ ফেলে পালিয়েছে মাফিয়া আমু’র ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার   জেলের স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে হিজলা মৎস্য কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণ   বরগুনার কৃষি কর্মকর্তার অফিসই বাসা!   বরিশালে ভাই-ভাই দ্বন্দ্বে বড়ভাইকে মারধর   বাগেরহাটে বিএনপি নেতা ওয়াহিদুজ্জামান দিপুর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড
Translate »